ঢাকার মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে গত মঙ্গলবার দুপুরে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ড এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরো নগরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সামনে। সাত তলা ওই ভবনের পার্শ্ববর্তী রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগার পর তা বিস্ফোরণ হয়ে পাশের পোশাক কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে। ২৫ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে শেষে কিছুটা নিয়ন্ত্রনে আনা হয়। তবে এখনও ধোঁয়া উঠছে, এবং উদ্ধার অভিযান শুরু করা যায়নি পুরোভাবে। এই দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত হয়েছেন — যারা পরিবার, কর্মী ও সমাজ সবাইকে শোকস্তব্ধ করেছে।
মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আলম ট্রেডার্স নামে ওই রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগে। আগুন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যে চারতলা ভবনের দোতলা ও তৃতীয় তলায় প্রতিষ্ঠিত পোশাক ও প্রিন্টিং কারখানাগুলো জ্বলে ওঠে। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টা লড়াই করে ওই ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে রাসায়নিক গুদামের আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে বুধবার দুপুর আড়াইটায় — یعنی প্রায় ২৭ ঘণ্টা পর।
দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবার বুধবার রাতে অপরাধ মামলা করেন, অভিযোগ করেন — “অবহেলাজনিত মৃত্যু।” মামলায় গুদামের মালিক শাহ আলম ও ব্যবস্থাপক কে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ জানায়, উভয়ই পলাতক।
এই ঘটনা শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়— একসময় অবহেলা ও আইনশৃঙ্খলার ফাঁকফোকর ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। তদন্ত করলে বোঝা যাবে কেন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো, এবং কে বা কারা এর জন্য দায়ি।
প্রথম দিকে উদ্ধারকারীদের কাছে অনেক বাধা ছিল। গুদামের ভেতরের ধোঁয়া, তাপ ও রাসায়নিক দ্রব্যের ভয় — এসব কারণে উদ্ধার অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি। ফায়ার সার্ভিস জানায়, গুদামে যে রাসায়নিক দ্রব্য ছিল তার ধ্বংস ও পরিস্কারকরণ সময়সাপেক্ষ। রাসায়নিক অধিকাংশ “দাঁতে দাঁতে” থাকায় ধোঁয়া ও গ্যাস দীর্ঘসময় ধরে ছড়িয়ে থাকতে পারে। তাই ধীরে ধীরে কাজ করা হচ্ছে।
একাধিক সংবাদে বলা হয়েছে যে এই গুদাম অবৈধ ছিল। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক অপারেশন অ্যান্ড মেইন্টেনেন্স কর্নেল তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, আগের কয়েকবার ওই গুদামে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। অথচ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
নিহতদের মধ্যে ৭ জনকে ইতোমধ্যে স্বজনেরা শনাক্ত করেছেন। তারা মরদেহ হস্তান্তরের জন্য ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ পরীক্ষার অপেক্ষায় রয়েছেন।
এ ঘটনায় নিরাপত্তা, তদারকি ও আইন প্রয়োগ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা আবার সামনে এসেছে। ঢাকার আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক গুদাম ও শিল্পকারখানা স্থাপন করার অনুমোদন ও তদারকি ঘাটতির অভিযোগ আগেও উঠেছে। অনেক গুদাম ও কারখানাই বর্জনযোগ্য অনুমোদন ও মানদণ্ড ছাড়িয়ে চলে। এ ধরনের অবৈধ গুদাম ও কারখানাকে খুঁজে বের করা এবং নিয়মিত পরিদর্শন পরিচালনা করা এখন অতি জরুরি।
সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ— প্রত্যেককে এখনই দায়িত্ব নিতে হবে। আসামিদের দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা দ্রুত নির্দিষ্টভাবে নিরাপদ করা জরুরি। পাশাপাশি ভবন নির্মাণ ও কারখানার নিরাপত্তার মানদণ্ড কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
কারখানার শ্রমিকদের নিরাপত্তা—অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা, জরুরি প্রস্থান পথ, আগুন লাগলে দ্রুত জনগুরুত্ত্বপূর্ণ পদক্ষেপ—এসব ছিল কি ঠিকভাবে ছিল? এসব বিষয়ও তদন্তে উঠে আসবে। কারণ অনেক সময় শুধু নিয়ম না মেনে প্রতিষ্ঠানে কাজ করাই বড় বিপদ ডেকে আনে।
এ দুর্ঘটনা শুধু মিরপুরের নয়, পুরো ঢাকার জন্য এক সতর্ক সংকেত। শহরের কেন্দ্রগুলিতে ভবন ও গুদাম ব্যবহারে নিয়ম মেনে চলা হচ্ছে কি না, বেঁচে থাকা মানুষের জীবন ও তাদের অধিকার কতটা সুরক্ষিত তা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
নিহতদের প্রতি শোক, আহতদের তড়িৎ চিকিৎসা, স্বজনদের পুনর্বাসন—সবই জরুরি। পাশাপাশি ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা রোধে আইন প্রয়োগ, দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আপনার মতামত জানানঃ