ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে শনিবার দুপুরে যে আগুন লাগে, তার ধোঁয়া রবিবার সকাল পর্যন্তও পুরোপুরি থামেনি। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পরও এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পোড়া পণ্যের গন্ধ আর ধোঁয়া আকাশে মিশে থাকে। শনিবার রাত পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আগুন নেভানোর চেষ্টা চালালেও, রবিবার সকালেও উদ্ধারকাজ অব্যাহত ছিল।
বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ হলো এমন একটি জায়গা যেখানে বিদেশ থেকে আমদানি করা বিভিন্ন পণ্য সাময়িকভাবে সংরক্ষণ করা হয়। এখানে ছোট-বড় অসংখ্য গুদাম ও পণ্য রাখার খোলা জায়গা রয়েছে। শনিবার দুপুরে হঠাৎ করেই এই এলাকার একটি অংশে আগুন লাগে। মুহূর্তের মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, আর তাতে বিশাল এলাকা ঘন কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায়। আগুনের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একের পর এক ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়।
বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু বাতাসের তীব্রতা এবং জায়গার গঠনগত জটিলতার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লেগে যায়। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল জানিয়েছেন, খোলা জায়গা এবং পণ্যের ঘন বিন্যাসের কারণে আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে দ্রুত। তিনি বলেন, “যেহেতু বাতাস ছিল প্রবল, তাই অক্সিজেনের সরবরাহ আগুনকে জ্বলতে সাহায্য করেছে।” এছাড়া কার্গো ভিলেজের যে অংশে আগুন লেগেছে, সেখানে ছোট ছোট খোপে পণ্য রাখা থাকায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পক্ষে ভেতরে প্রবেশ করে আগুন নেভানো কঠিন হয়ে পড়ে।
এছাড়া ধারণা করা হচ্ছে, যেখানে আগুন লেগেছে, সেখানে রাসায়নিক জাতীয় দ্রব্য বা দাহ্য পদার্থও থাকতে পারে। এই কারণে বাড়তি সতর্কতা নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ করতে হয়েছে, যাতে আরও বড় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে। রাত প্রায় ৯টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে, তবে তখনও আগুনের ভেতরে জ্বলতে থাকা পণ্য থেকে ধোঁয়া উঠছিল।
এই অগ্নিকাণ্ডের সময় বিমানবন্দরের কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে যায়। অনেক ফ্লাইট বাতিল বা বিলম্বিত হয়। যে বিমানগুলো তখন ঢাকায় নামার কথা ছিল, তাদের চট্টগ্রাম ও সিলেটের দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়। প্রায় ছয় ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর রাত সোয়া নয়টার দিকে বিমান ওঠানামা আবার শুরু হয়। যদিও রবিবার সকালেও কিছু ফ্লাইট নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরিতে ছাড়ে। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শনিবার আটকে পড়া ফ্লাইটগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ছাড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আগুন লাগার ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ কার্গো ভিলেজে মূলত বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য রাখা থাকে। অনেক ব্যবসায়ী সেখানে তাদের পণ্য সংরক্ষণ করছিলেন, যেগুলোর বেশিরভাগই আগুনে পুড়ে গেছে। শনিবার রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনলাইন ব্যবসায়ীরা ক্ষতির খবর জানাতে থাকেন। কেউ কেউ বলছেন, তাদের লাখ লাখ টাকার পণ্য আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে। অনেকেই ঘটনাস্থলে এসে পোড়া গুদামের পাশে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।
ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন সদস্যও আগুন নেভানোর সময় আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। পুরো এলাকা ঘিরে ছিল আনসার ও পুলিশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিমানবন্দর এলাকায় যান চলাচলও কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখতে হয়। এই ঘটনায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় আলাদা দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তারা আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধান করবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস টিম এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যদি এসব ঘটনার পেছনে নাশকতা বা আতঙ্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্য পাওয়া যায়, তাহলে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে। নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে ইতোমধ্যে ঘটনাগুলো গভীরভাবে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা বশির উদ্দিন রবিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে জানিয়েছেন, আগুনের কারণে যে ফ্লাইট শিডিউলে বিপর্যয় ঘটেছে তা মোকাবেলায় সরকার তিন দিনের জন্য অতিরিক্ত বা নন-শিডিউল ফ্লাইটের মাসুল মওকুফ করেছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এতে ফ্লাইট পরিচালনা স্বাভাবিক হতে সময় কম লাগবে।
কার্গো ভিলেজের এই অংশে নানা ধরনের আমদানিকৃত পণ্য রাখা হতো — ইলেকট্রনিক সামগ্রী, পোশাক, মেশিনারি, এমনকি কিছু দাহ্য পদার্থও। আগুন লাগার সময় কেউ কেউ ভেতরে কাজ করছিলেন, তবে সময়মতো বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। সৌভাগ্যক্রমে বড় কোনো প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি।
আগুনের পর বিমানবন্দর এলাকায় ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ায় আশেপাশের লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বিমানবন্দরের আশপাশের হোটেল ও দোকানগুলোও সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়, তবে ক্ষতির পরিমাণ এখনও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।
ঘটনার পর অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, বিমানবন্দরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা কার্যকর ছিল। ব্যবসায়ী ও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে যে, যদি এমন জায়গায় এত বড় আগুন লাগে, তাহলে দেশের অন্যান্য গুদাম ও কারখানার অবস্থা কী হতে পারে।
এই আগুন শুধু পণ্য ও অর্থের ক্ষতি নয়, মানুষের মনে তৈরি করেছে এক গভীর অনিশ্চয়তা। অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যাদের পণ্য পুড়ে গেছে, তারা বলছেন, এখন তাদের পক্ষে ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব। কেউ কেউ ব্যাংক ঋণে ব্যবসা চালাচ্ছিলেন, এখন তারা জানেন না কীভাবে সেই ঋণ শোধ করবেন।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, তারা পুরো এলাকা পরিদর্শন করে দেখছে কোথাও আগুনের অবশিষ্ট স্ফুলিঙ্গ রয়েছে কিনা, যাতে পুনরায় আগুন না লাগে। একই সঙ্গে তদন্ত দল ঘটনাস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছে, যেগুলো পরীক্ষা করে জানা যাবে আগুনের উৎস কী ছিল।
বিমানবন্দরের এই অগ্নিকাণ্ড আবারও মনে করিয়ে দিলো, নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি ও অসাবধানতা কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, আগুন প্রতিরোধে নিয়মিত মহড়া, পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ও প্রশিক্ষণ থাকা অত্যন্ত জরুরি।
ঢাকার আকাশে রবিবার সকালেও যখন হালকা ধোঁয়া ভাসছিল, তখন অনেকেই বিমানবন্দরের পাশে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছিলেন। কেউ মোবাইলে ভিডিও করছিলেন, কেউ নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলেন পোড়া গন্ধের মধ্যে। আগুন নেভানো গেছে ঠিকই, কিন্তু তার ছায়া রয়ে গেছে বহু মানুষের জীবনে। এই আগুন কেবল একটি গুদাম নয়, পুড়িয়ে দিয়েছে অনেক মানুষের আশা, পরিশ্রম আর স্বপ্নের অংশবিশেষ।
আপনার মতামত জানানঃ