ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যখন টানটান উত্তেজনা, ঠিক সেই মুহূর্তে বিএনপির ভেতরে বড় ধরনের ভাঙনের ইঙ্গিত দিল রুমিন ফারহানাসহ নয় নেতাকে বহিষ্কারের ঘটনা। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার পরদিনই দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করার অভিযোগে এই বহিষ্কার শুধু একটি সাংগঠনিক পদক্ষেপ নয়, বরং বিএনপির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক কৌশল, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা এবং ভবিষ্যৎ পথচলার ওপর গভীর প্রশ্ন তুলে দিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও একটি নাটকীয় ও আবেগঘন বাস্তবতা—এই বহিষ্কারের দিনই সকালে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ফলে ঘটনাটি রাজনৈতিক হিসাব–নিকাশের গণ্ডি পেরিয়ে শোক, অনিশ্চয়তা ও দ্বিধার এক জটিল আবহ তৈরি করেছে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় রুমিন ফারহানাসহ নয়জনকে দলের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কৃতদের মধ্যে রয়েছেন জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, নির্বাহী কমিটির আরও চার সদস্য, ঢাকা ও সিলেটের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা এবং সংখ্যালঘু সংগঠনের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা। তালিকাটি শুধু সংখ্যার দিক থেকে নয়, রাজনৈতিক গুরুত্বের দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পরিসরে সক্রিয় ছিলেন এবং গণমাধ্যম ও সংসদে দলটির মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
বহিষ্কারের পেছনের তাৎক্ষণিক কারণ স্পষ্ট—দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে তারা স্বতন্ত্র বা বিকল্পভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। বিএনপির ঘোষিত সিদ্ধান্ত ছিল, দলীয় কৌশল অনুযায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে কেন্দ্রীয়ভাবে যে নির্দেশনা দেওয়া হবে, তার বাইরে কেউ যাবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, পৌনে ২০০–এর বেশি নেতা দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এই নয়জন বহিষ্কৃত নেতা সেই বৃহত্তর প্রবণতারই সবচেয়ে দৃশ্যমান অংশ।
এখানেই প্রশ্ন ওঠে—এই বহিষ্কার কি শুধুই শৃঙ্খলা রক্ষার পদক্ষেপ, নাকি এটি বিএনপির ভেতরের দীর্ঘদিনের চাপা ক্ষোভ ও বিভক্তির বহিঃপ্রকাশ? রুমিন ফারহানার মতো নেতারা এতদিন বিএনপির তথাকথিত ‘সংস্কারপন্থী’ ও যুক্তিনির্ভর কণ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সংসদে ও টকশোতে তিনি দলীয় অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন তুলনামূলকভাবে সংযত ভাষায়। তার বহিষ্কার তাই অনেকের কাছেই শুধু ব্যক্তিগত শাস্তি নয়, বরং বিএনপির রাজনৈতিক লাইনের আরও কট্টর হয়ে ওঠার ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই সিদ্ধান্তের সময় নির্বাচন করাটাও কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। সোমবার ছিল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। ঠিক তার পরদিনই বহিষ্কারের ঘোষণা আসে। অর্থাৎ দল স্পষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছে—মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে ফেললেও দলীয় শাস্তি থেকে রেহাই নেই। কিন্তু একই দিনে খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবর পুরো রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। খালেদা জিয়া শুধু বিএনপির চেয়ারপারসনই নন, দলটির ঐক্যের প্রতীকও ছিলেন। দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকেও তিনি ছিলেন বিএনপির শেষ ভরসার জায়গা। তার মৃত্যুর দিনই দলীয় বহিষ্কারের ঘোষণা আসা স্বাভাবিকভাবেই আবেগ ও রাজনীতিকে এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছে।
বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এই বহিষ্কার নতুন নয়, তবে প্রেক্ষাপট আলাদা। অতীতেও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করার অভিযোগে অনেককে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু এবার বিষয়টি ঘটছে এমন এক সময়ে, যখন বিএনপি নিজেই নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশগ্রহণের প্রশ্নে বিভক্ত। একদিকে রয়েছে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদীয় রাজনীতিতে টিকে থাকার যুক্তি, অন্যদিকে রয়েছে অংশগ্রহণ না করে আন্দোলনের রাজনীতি জোরদার করার কৌশল। যারা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, তারা কার্যত প্রথম পথটিকেই বেছে নিয়েছেন—হয়তো দলীয় ছাতার বাইরে হলেও।
এই বাস্তবতা বিএনপির জন্য অস্বস্তিকর। কারণ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে এত বড় সংখ্যক নেতা নির্বাচনে নামা মানে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হওয়ার ইঙ্গিত। বহিষ্কার সেই দুর্বলতা ঢাকার চেষ্টা হিসেবেও দেখা যেতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই বহিষ্কার কি সত্যিই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে, নাকি বিদ্রোহী মনোভাবকে আরও উসকে দেবে?
বহিষ্কৃতদের তালিকায় সংখ্যালঘু সংগঠনের নেতা তরুণ দের নামও রয়েছে। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের মহাসচিব হিসেবে তিনি বিএনপির সংখ্যালঘু রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মুখ ছিলেন। তার বহিষ্কার বিএনপির সংখ্যালঘু ভোটব্যাংক ও ভাবমূর্তির ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। একইভাবে ঢাকা মহানগর উত্তর ও সিলেটের নেতাদের বহিষ্কার স্থানীয় রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে, যেখানে বিএনপি এমনিতেই সংগঠনিকভাবে চাপে রয়েছে।
এই ঘটনাপ্রবাহের আরেকটি দিক হলো জনমত। বিএনপির সমর্থকদের একাংশ মনে করছেন, দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য এই কঠোর সিদ্ধান্ত জরুরি ছিল। তাদের যুক্তি, দল যদি কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে না পারে, তবে তা রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে। আবার অন্য অংশের মতে, বহিষ্কার করে সমস্যার সমাধান হয় না; বরং এতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র আরও সংকুচিত হয় এবং ভিন্নমত দমন করার বার্তা যায়।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুর পর এই বিতর্ক আরও তীব্র হতে পারে। তার অনুপস্থিতিতে বিএনপির নেতৃত্ব কাঠামো নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘদিন ধরে দল পরিচালনা করলেও মাঠপর্যায়ে তার সরাসরি উপস্থিতি নেই। এই প্রেক্ষাপটে দলীয় ঐক্য ধরে রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রুমিন ফারহানাসহ নয় নেতার বহিষ্কার সেই ঐক্যকে শক্ত করবে নাকি আরও ভাঙবে—এই প্রশ্নের উত্তর এখনই স্পষ্ট নয়।
একই সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির বড় ছবিটিও বিবেচনায় রাখতে হয়। নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির এই অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন ক্ষমতাসীন দলের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে। বিভক্ত ও দুর্বল বিরোধী দল মানেই নির্বাচনী মাঠে অসম প্রতিযোগিতা। বহিষ্কৃত নেতারা যদি স্বতন্ত্র হিসেবে মাঠে থাকেন, তবে বিএনপির ভোটব্যাংক আরও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সব মিলিয়ে, রুমিন ফারহানাসহ নয় নেতার বহিষ্কার একটি দিনের ঘটনা হলেও এর রাজনৈতিক অভিঘাত দীর্ঘমেয়াদি। এটি বিএনপির ভেতরের ক্ষমতার কাঠামো, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধরন এবং ভবিষ্যৎ কৌশল—সবকিছুর ওপর ছাপ ফেলবে। খালেদা জিয়ার মৃত্যুর শোকের মধ্যেই দল যে কঠোর সাংগঠনিক বার্তা দিল, তা হয়তো তাদের দৃঢ়তার প্রকাশ, আবার অনেকের চোখে এটি অনিশ্চয়তা ও ভাঙনেরও প্রতীক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই বহিষ্কার তাই শুধু একটি খবর নয়, বরং চলমান রাজনৈতিক নাটকের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যার পরিণতি নির্ভর করবে আগামী দিনগুলোতে বিএনপি কোন পথে হাঁটে তার ওপর।
আপনার মতামত জানানঃ