দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে ভারতের সঙ্গে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক এক গভীর চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই চাপ কোনো একক দ্বিপক্ষীয় বিরোধের ফল নয়; বরং এটি একটি কাঠামোগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত, যা পুরো অঞ্চলে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান টানাপোড়েন, পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম সীমান্তে স্থায়ী উত্তেজনা, আর নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের কৌশলগত অবস্থান বদলে যাওয়া—সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব যে চ্যালেঞ্জের মুখে, তা আর আড়াল করা যাচ্ছে না। এই পরিবর্তনের মূল কারণ হিসেবে উঠে আসছে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের প্রতি বাড়তে থাকা অবিশ্বাস, যা জন্ম নিয়েছে নিরাপত্তা-কেন্দ্রিক কূটনীতি, আদর্শিক বার্তা এবং আগ্রাসী নেতৃত্বের ভাষা থেকে।
“নেইবারহুড ফার্স্ট” নীতির আওতায় সংযোগ, বাণিজ্য ও সহযোগিতার যে প্রতিশ্রুতি ভারত দিয়েছিল, বাস্তবে তার প্রত্যাশিত প্রভাব পড়েনি। বাংলাদেশে প্রায় ৭.৯ বিলিয়ন ডলার এবং নেপালে ১.৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা দিয়ে ভারত পারস্পরিক নির্ভরতার বার্তা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক উদ্যোগ সত্ত্বেও আস্থা গড়ে ওঠেনি। এর পাশাপাশি আদর্শিক রাজনীতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। “অখণ্ড ভারত”-এর মতো হিন্দুত্ববাদী ধারণা এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ শীর্ষ নেতাদের কড়া বক্তব্য প্রতিবেশীদের কাছে ভারতের এক হস্তক্ষেপমূলক ও আধিপত্যবাদী ভাবমূর্তি তৈরি করেছে। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ক্রমেই বিকল্প কৌশল খুঁজছে এবং বহুমুখী শক্তির ভারসাম্যের পথে হাঁটছে।
এক দশকেরও বেশি আগে ঘোষিত “নেইবারহুড ফার্স্ট” নীতির উদ্দেশ্য ছিল আঞ্চলিক সংযোগ জোরদার করা, বাণিজ্য সহজ করা এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক গভীর করা। লক্ষ্য ছিল ভারতকে এমন এক সহযোগী নেতা হিসেবে তুলে ধরা, যে বাংলাদেশ, নেপাল কিংবা মালদ্বীপের মতো দেশগুলোকে সহায়তা দিতে প্রস্তুত। উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক সফরের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল।
বাস্তবে এই নীতির কিছু ইতিবাচক ফলও দেখা গেছে। বাংলাদেশ, নেপাল ও মালদ্বীপে অবকাঠামো, জ্বালানি ও পরিবহন খাতে ঋণ সহায়তার মাধ্যমে ভারত নিজেকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মানবিক সহায়তাও ভারতের ভাবমূর্তি শক্ত করেছিল।
তবে বাস্তবায়নের পর্যায়ে এই নীতি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ভূখণ্ড ও পানি বিরোধ, بيرোক্রেটিক জটিলতা এবং ভারতীয় ঠিকাদার ব্যবহারের শর্তের কারণে অনেক প্রকল্প বিলম্বিত হয়। বাংলাদেশ দীর্ঘসূত্রতার কারণে ১১টি প্রকল্প বাতিল করে, যেখানে একাধিক অনুমোদন ও ভারতীয় পরামর্শক নিয়োগ বাধ্যতামূলক ছিল। নেপালেও একই ধরনের অভিযোগ ওঠে। এসব ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতায় নীতি, বাস্তবায়ন ও ধারণার মধ্যকার জটিল সম্পর্ককে স্পষ্ট করে তোলে।
রাজনৈতিক পরিবর্তন ও ভূকৌশলগত বাস্তবতার কারণে ভারতের প্রতিবেশীরা এখন নিজেদের স্বার্থে নতুন ভারসাম্য খুঁজছে। বাংলাদেশ এর একটি বড় উদাহরণ। ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের পথে হাঁটে। এটি ভারতের ওপর দীর্ঘদিনের নির্ভরতা থেকে সরে আসার একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা। সামাজিক আন্দোলনের নেতা শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব তীব্র হয়। যদিও ভারতের সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ নেই, তবু হত্যাকারীরা ভারতে পালিয়েছে—এই অভিযোগ ঘিরে ঢাকায় ভারতীয় কূটনৈতিক স্থাপনায় হামলার ঘটনাও ঘটে। এতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে ওঠে।
নেপালের ক্ষেত্রে ২০১৫-১৬ সালের অর্থনৈতিক অবরোধের স্মৃতি এখনো তাজা। অনেকের ধারণা, সংবিধান পরিবর্তনের সময় ভারত চাপ সৃষ্টি করেছিল। এই অভিজ্ঞতা নেপালকে ভারতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার ঝুঁকি বুঝিয়ে দেয়। ফলস্বরূপ, কাঠমান্ডু চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যুক্ত হয়। এটি ভারতের পাশাপাশি চীনের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার একটি কৌশল।
শ্রীলঙ্কার দীর্ঘ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটও দেশটিকে চীনের দিকে আরও ঝুঁকতে বাধ্য করেছে। ঋণ ও কূটনৈতিক সহায়তার ক্ষেত্রে বেইজিং এখন ভারতের প্রভাবের ভারসাম্য হিসেবে কাজ করছে। মালদ্বীপে এই পরিবর্তন আরও প্রকাশ্য। “ইন্ডিয়া আউট” স্লোগানকে কেন্দ্র করে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর উত্থান ঘটে। ক্ষমতায় এসে তিনি মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সামরিক উপস্থিতি প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেন, যা ২০২৪ সালের মে মাসে সম্পন্ন হয়। যদিও দুই দেশের যোগাযোগ পুরোপুরি ছিন্ন হয়নি, তবু মালদ্বীপ স্পষ্টভাবে ভারতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমাতে চাইছে।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কেও উত্তেজনা অব্যাহত। সীমান্ত সংঘর্ষ, ২০২৫ সালের মে মাসের সামরিক উত্তেজনা এবং কার্যকর কূটনৈতিক সংলাপের অভাব এই সম্পর্ককে কাঠামোগতভাবে স্থবির করে রেখেছে।
এই সব উদাহরণ মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বহুমুখী শক্তিকেন্দ্রিক ব্যবস্থার উত্থান স্পষ্ট। ছোট রাষ্ট্রগুলো এখন এককভাবে ভারতের দিকে ঝুঁকে না থেকে বিভিন্ন শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে চাইছে।
এই বাস্তবতার পেছনে দুটি বিষয় বিশেষভাবে কাজ করছে—আদর্শিক ভাষ্য এবং নিরাপত্তা-কেন্দ্রিক কূটনীতি। বর্তমান নেতৃত্বে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নিরপেক্ষ না থেকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রতীকে ভর করছে। নতুন সংসদ ভবনে “অখণ্ড ভারত”-এর মানচিত্র প্রদর্শন প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এসব প্রতীকী বার্তা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জনপ্রিয় হলেও প্রতিবেশীদের কাছে সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হিসেবে ধরা পড়ছে।
এর পাশাপাশি ভারতের সামরিক প্রস্তুতি ও সীমান্তে শক্তি প্রদর্শনও আস্থার ঘাটতি বাড়াচ্ছে। লাদাখে নতুন বিমানঘাঁটি, নেপাল ও পাকিস্তান সীমান্তে ড্রোন নজরদারি এবং একাধিক সামরিক মহড়া প্রতিবেশীদের কাছে কূটনীতির চেয়ে নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ইঙ্গিত দেয়।
দক্ষিণ এশিয়ায় যেখানে দেশগুলো কৌশলগত ভারসাম্যকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, সেখানে ভারতের আদর্শিক প্রতীক ও সামরিক কূটনীতি বাস্তব সহযোগিতার ক্ষেত্র সংকুচিত করছে। ৬২ বিলিয়ন ডলারের সম্ভাব্য আঞ্চলিক বাণিজ্য থাকা সত্ত্বেও আস্থার অভাবে ভারত তার অর্ধেকও কাজে লাগাতে পারছে না। এই বাস্তবতা স্পষ্ট করে দেয়—দক্ষিণ এশিয়া এখন এক নতুন কৌশলগত অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে, যেখানে ভারতের প্রভাব আর স্বতঃসিদ্ধ নয়, বরং প্রতিযোগিতার মুখে।
আপনার মতামত জানানঃ