
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সাম্প্রতিক বক্তব্য আন্তর্জাতিক রাজনীতির উত্তপ্ত বাস্তবতাকে আরও একবার নগ্নভাবে সামনে নিয়ে এসেছে। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি যখন বলেন যে ইরান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও ইউরোপের সঙ্গে ‘পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের মধ্যে’ রয়েছে, তখন সেটি কেবল একটি কূটনৈতিক বক্তব্য নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে জমে ওঠা বৈরিতা, অবিশ্বাস ও সংঘাতের মনস্তাত্ত্বিক প্রকাশ। তাঁর ভাষায় এই যুদ্ধ এখন আর প্রচলিত সামরিক সংঘর্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি চারদিক থেকে ঘিরে ধরা এক জটিল, বহুস্তরীয় লড়াই, যেখানে অর্থনীতি, নিষেধাজ্ঞা, সাইবার হামলা, গোয়েন্দা তৎপরতা এবং রাজনৈতিক চাপ—সবই অস্ত্র।
পেজেশকিয়ান স্পষ্ট করেই বলেছেন, তাঁর দৃষ্টিতে ইরান ইতিমধ্যেই পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে যুদ্ধে আবদ্ধ। এই যুদ্ধের লক্ষ্য ইরানকে অস্থিতিশীল করা, দেশটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিত দুর্বল করা এবং সর্বোপরি এর পারমাণবিক সক্ষমতাকে চিরতরে থামিয়ে দেওয়া। তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও ইউরোপের কৌশলগত স্বার্থ এক জায়গায় এসে মিলেছে—ইরানকে একটি নিয়ন্ত্রিত, দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত করা। তাঁর বক্তব্যে যে আত্মরক্ষামূলক মনোভাব স্পষ্ট, তা ইরানের শাসকগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বয়ানের সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এই প্রেক্ষাপটে পেজেশকিয়ান যখন ১৯৮০-১৯৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধের কথা স্মরণ করেন, তখন সেটি কেবল ইতিহাসচর্চা নয়, বরং একটি সতর্কবার্তা। সেই যুদ্ধে প্রায় দশ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল, দেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো বিপর্যস্ত হয়েছিল, তবুও যুদ্ধের চরিত্র ছিল তুলনামূলকভাবে ‘স্পষ্ট’। শত্রু কে, আক্রমণ কোথা থেকে আসছে, জবাব কোথায় দিতে হবে—সবই মোটামুটি জানা ছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিকে তিনি সেই যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ বলে বর্ণনা করেন, কারণ এখানে যুদ্ধের রেখাগুলো অস্পষ্ট। কখনো নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে অর্থনৈতিক শ্বাসরোধ, কখনো সাইবার আক্রমণে অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত করা, কখনো গোপন হামলা বা লক্ষ্যভিত্তিক হত্যাকাণ্ড—এই যুদ্ধের ধরন বহুমাত্রিক ও অনির্দিষ্ট।
ইরানের দৃষ্টিতে এই ‘ঘেরাও যুদ্ধ’ সবচেয়ে প্রকটভাবে ধরা পড়ে পারমাণবিক ইস্যুতে। পশ্চিমা বিশ্ব দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে সন্দেহের চোখে দেখছে। তেহরানের দাবি, তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম শান্তিপূর্ণ ও জ্বালানি উৎপাদনের জন্য, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল বরাবরই আশঙ্কা করে আসছে যে ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে এগোচ্ছে। এই সন্দেহ থেকেই একের পর এক নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক চাপ এবং শেষ পর্যন্ত সামরিক হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
চলতি বছরের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যে সামরিক হামলা চালানো হয়, তা এই উত্তেজনারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই হামলায় ইরানের সক্ষমতা কিছুটা পিছিয়ে যায়, তবে তা পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। পেজেশকিয়ান তাঁর বক্তব্যে এই হামলার প্রভাবকে গুরুত্বহীন বলে মন্তব্য করেন, যা মূলত অভ্যন্তরীণ জনমতকে শক্ত রাখার কৌশল হিসেবেই দেখা হচ্ছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইরানের সামরিক বাহিনী আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী হয়েছে এবং ভবিষ্যতে কোনো হামলা হলে তার জবাব হবে আরও কঠোর।
এই বক্তব্যের সময়টিও তাৎপর্যপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন এবং সেখানে ইরান আলোচনার মূল ইস্যু হতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই তেহরান থেকে এমন কড়া বার্তা দেওয়া নিছক কাকতাল নয়। এটি একদিকে যেমন পশ্চিমা শক্তিগুলোর প্রতি হুঁশিয়ারি, অন্যদিকে তেমনি দেশের ভেতরে রাজনৈতিক দৃঢ়তার প্রদর্শন। ইরানের নেতৃত্ব জানে, বহির্বিশ্বের চাপ যত বাড়বে, অভ্যন্তরীণ ঐক্য ধরে রাখাও তত কঠিন হয়ে উঠবে। ফলে শক্ত ভাষা ও প্রতিরোধের বার্তা দিয়ে জনগণকে এক পতাকার নিচে আনার চেষ্টা নতুন কিছু নয়।
তবে এই ‘পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ’ ধারণাটি বাস্তবে কতটা সামরিক, আর কতটা রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক—সেটিই মূল প্রশ্ন। বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সরাসরি সর্বাত্মক যুদ্ধ এখনো হয়নি। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরেই চাপে। মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট—সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠেছে। এই অর্থনৈতিক যন্ত্রণা অনেকাংশেই পশ্চিমা চাপের ফল, যা ইরান সরকার ‘যুদ্ধের’ অংশ হিসেবেই ব্যাখ্যা করে।
ইসরাইলের ক্ষেত্রেও সংঘাতটি মূলত ছায়াযুদ্ধের মতো। সিরিয়ায় ইরান-সমর্থিত ঘাঁটিতে ইসরাইলের বিমান হামলা, ইরানের ভেতরে রহস্যজনক বিস্ফোরণ বা বিজ্ঞানীদের হত্যাকাণ্ড—এসবই প্রকাশ্য যুদ্ধ নয়, কিন্তু সংঘাতের বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায়ও নেই। ইউরোপীয় দেশগুলো তুলনামূলকভাবে নরম অবস্থানে থাকলেও, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিল রেখে তারাও নিষেধাজ্ঞা ও কূটনৈতিক চাপের অংশীদার।
এই পুরো পরিস্থিতিতে পেজেশকিয়ানের বক্তব্য এক ধরনের আত্মপক্ষসমর্থনও বটে। তিনি বোঝাতে চান, ইরানের বর্তমান সংকট অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতার ফল নয়, বরং বহিঃশত্রুর পরিকল্পিত আক্রমণের পরিণতি। এই বয়ান ইরানের রাজনীতিতে বহু পুরোনো এবং কার্যকরও। কারণ শত্রুর অস্তিত্ব দেখাতে পারলে শাসকগোষ্ঠীর চারপাশে সমালোচনার পরিসর সংকুচিত হয়।
তবে বাস্তবতার আরেকটি দিকও আছে। দীর্ঘদিনের সংঘাত ও নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান এমন এক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে প্রতিরোধ আর আপস—দুটোরই মূল্য চড়া। পারমাণবিক সক্ষমতা পুনর্গঠনের ঘোষণা একদিকে যেমন শক্তি প্রদর্শন, অন্যদিকে তেমনি এটি নতুন নিষেধাজ্ঞা ও সম্ভাব্য সামরিক সংঘাতের ঝুঁকিও বাড়ায়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল বারবার বলেছে, তারা ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে রাজি নয়। ফলে এই সংঘাতের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত।
পেজেশকিয়ানের কথায় যে আত্মবিশ্বাস শোনা যায়—ইরানের সামরিক বাহিনী এখন আগের চেয়ে শক্তিশালী—তা আংশিক সত্য হলেও সম্পূর্ণ চিত্র নয়। ইরান নিঃসন্দেহে আঞ্চলিকভাবে শক্তিশালী একটি সামরিক শক্তি, তাদের মিসাইল প্রযুক্তি ও প্রক্সি বাহিনী রয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে তারা একটি দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক যুদ্ধেও জড়িয়ে আছে, যার ক্ষয়ক্ষতি ধীরে ধীরে সমাজের গভীরে পৌঁছাচ্ছে।
এই কারণেই তাঁর ‘পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ’ মন্তব্যকে একমাত্র সামরিক বিশ্লেষণে সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক হবে না। এটি আসলে আধুনিক বিশ্বের যুদ্ধের রূপান্তরের প্রতিচ্ছবি—যেখানে যুদ্ধ মানে শুধু ট্যাংক ও মিসাইল নয়, বরং অর্থনীতি, তথ্য, মনস্তত্ত্ব ও কূটনীতির সম্মিলিত লড়াই। ইরান আজ সেই লড়াইয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, আর পেজেশকিয়ানের কণ্ঠে ধরা পড়েছে সেই চাপ, উদ্বেগ ও প্রতিরোধের মিশ্র অনুভূতি।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন থেকেই যায়—এই যুদ্ধ কত দূর যাবে? ইতিহাস দেখিয়েছে, ইরান বহিরাগত চাপের সামনে সহজে নতি স্বীকার করে না। আবার এটাও সত্য, দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত কোনো দেশের জন্যই টেকসই নয়। পেজেশকিয়ানের বক্তব্য হয়তো আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন, কিন্তু আগামী দিনের পথ কোন দিকে যাবে—তা নির্ভর করছে এই সংঘাত শেষ পর্যন্ত সংলাপে গড়ায়, নাকি আরও গভীর অস্থিরতার দিকে
আপনার মতামত জানানঃ