রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘ট্রান্সন্যাশনাল রিপ্রেশন’ বলতে বোঝানো হয়—যখন কোনো রাষ্ট্র তার ভৌগোলিক সীমানা ছাড়িয়ে অন্য রাষ্ট্রের ভেতরে গিয়ে বিরোধী কণ্ঠ, রাজনৈতিক ভিন্নমত কিংবা সংগঠিত আন্দোলনকে দমন করতে সক্রিয় হয়। একসময় এই ধারণা মূলত শীতল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত হতো। সিআইএ, কেজিবি, এমআইসিক্স বা মোসাদের মতো গোয়েন্দা সংস্থার গোপন অপারেশন, ডাবল এজেন্ট নিধন কিংবা কৌশলগত শত্রু রাষ্ট্রকে চাপে রাখার ঘটনাই ছিল এর প্রধান উদাহরণ। তখন এসব কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উচ্চতম স্তর বা আন্তর্জাতিক রাজনীতির ছায়াযুদ্ধে। সাধারণ নাগরিক, উদীয়মান রাজনৈতিক নেতা কিংবা প্রবাসী সামাজিক আন্দোলনকর্মীরা সচরাচর এই দমননীতির প্রত্যক্ষ শিকার হতেন না।
কিন্তু গত এক দশকে এই চিত্র নাটকীয়ভাবে বদলাতে শুরু করেছে। ট্রান্সন্যাশনাল রিপ্রেশন এখন আর শুধু গুপ্তচর বনাম গুপ্তচরের লড়াই নয়; বরং এটি ক্রমে বিস্তৃত হচ্ছে প্রবাসী কমিউনিটি, নাগরিক সমাজ এবং তরুণ রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিকে। কানাডায় শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ড, যুক্তরাষ্ট্রে গুরপতবন্ত সিং পান্নুনকে হত্যার ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত মামলা এবং সর্বশেষ বাংলাদেশে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড—এই ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ আর নেই। এগুলো একটি বৃহত্তর বৈশ্বিক প্রবণতার ইঙ্গিত দেয়, যেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ছায়ায় সীমান্ত অতিক্রম করে সহিংসতা ও দমনমূলক রাজনীতি বাস্তব রূপ নিচ্ছে।
শরিফ ওসমান হাদি ছিলেন বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক ব্যতিক্রমী তরুণ কণ্ঠ। তিনি ছিলেন এমন এক প্রজন্মের প্রতিনিধি, যারা প্রচলিত দলীয় রাজনীতির বাইরে দাঁড়িয়ে ন্যায়বিচার, ইনসাফ ও রাষ্ট্রীয় জবাবদিহির কথা বলছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ইনকিলাব মঞ্চ ক্রমেই একটি পরিচিত নাম হয়ে উঠছিল—বিশেষত তরুণদের মধ্যে। এই উত্থানের মাঝেই তাঁকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। আরও বিস্ময়কর ও উদ্বেগজনক হলো, হত্যাকাণ্ডের পরপরই অভিযুক্ত আততায়ী ভারতের দিকে পালিয়ে গেছে—এই বিশ্বাস বাংলাদেশের জনমনে ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন থাকলেও জনমতের আদালতে সন্দেহের তীর স্পষ্টভাবে এক দিকেই নির্দেশ করছে।
এই সন্দেহ শূন্যে ভাসমান নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের বিরুদ্ধে বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক হত্যা ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ একাধিক রাষ্ট্রে উঠেছে। কানাডার মতো শান্তিবাদী ও আইনের শাসনে বিশ্বাসী দেশে একজন নাগরিক নেতাকে হত্যা এবং সেই ঘটনায় ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বড় ধরনের অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সংসদে দাঁড়িয়ে ‘বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ’-এর কথা বলা কূটনৈতিক ইতিহাসে বিরল ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্র তো আরও এক ধাপ এগিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে, যেখানে ভারতীয় এক সরকারি কর্মচারীর নাম সরাসরি উঠে এসেছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ঘটনাটি নতুন কোনো বিচ্ছিন্ন অধ্যায় নয়, বরং একই ধারাবাহিকতার অংশ বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। পার্থক্য হলো, এখানে ভুক্তভোগী একজন প্রবাসী নন; বরং নিজ দেশেই সক্রিয় একজন তরুণ রাজনৈতিক নেতা। যদি সত্যিই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আন্তরাষ্ট্রীয় মদদ বা আশ্রয়ের যোগসূত্র প্রমাণিত হয়, তবে সেটি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এক নতুন ও ভয়াবহ নজির স্থাপন করবে।
ভারতের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি এই ঘটনাগুলোর ফলে গভীর সংকটে পড়েছে। একুশ শতকের শুরুতে ভারতকে দেখা হচ্ছিল বৈশ্বিক দক্ষিণের সম্ভাব্য নেতা হিসেবে—একটি উদীয়মান অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও মানবসম্পদের শক্তিশালী কেন্দ্র এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বাহক রাষ্ট্র হিসেবে। কিন্তু আজ সেই আখ্যান ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে। সফট পাওয়ারের জায়গায় হার্ড ও ছায়া-ক্ষমতার অভিযোগ জায়গা করে নিচ্ছে। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা ও কৌশলগত অংশীদার দেশগুলোতেও ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ‘চূড়ান্ত রায়’ অপেক্ষার বিলাসিতা খুব কম ক্ষেত্রেই থাকে। এখানে আখ্যানই বাস্তবতাকে অনেকাংশে নির্ধারণ করে। সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধান, গোয়েন্দা তথ্যের ফাঁস, আদালতের নথি এবং রাজনৈতিক বক্তব্য—সব মিলিয়ে একটি রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে বা ভেঙে পড়ে। কানাডার নাগরিকদের ভারতের প্রতি সমর্থন যে অল্প কয়েক বছরে অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে, তা এই আখ্যানগত বিপর্যয়েরই প্রতিফলন।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও সংবেদনশীল। দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সহযোগিতা—সবকিছুর ওপরই এই ধরনের অভিযোগ ছায়া ফেলছে। বাংলাদেশের মানুষের মনে যদি এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে একজন ন্যায়বিচারকামী তরুণ নেতা হত্যার পর বিচার এড়াতে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় পেয়েছে, তবে সেটি কেবল একটি অপরাধের প্রশ্নে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এটি জাতীয় মর্যাদা, সার্বভৌমত্ব এবং জনগণের আত্মসম্মানের প্রশ্নে রূপ নেবে।
আইনের শাসনের দৃষ্টিকোণ থেকে ট্রান্সন্যাশনাল রিপ্রেশন সবচেয়ে বিপজ্জনক এই কারণে যে, এটি আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোকেই চ্যালেঞ্জ করে। প্রত্যর্পণ চুক্তি, পারস্পরিক আইনি সহায়তা এবং কূটনৈতিক আস্থার ভিত্তি তখন নড়বড়ে হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যম থাকায় সেখানে এই ধরনের অভিযোগ প্রকাশ্যে আসছে এবং রাষ্ট্রগুলো চাপের মুখে পড়ছে। বাংলাদেশে সেই চাপের ধরন ভিন্ন হলেও জনমতের শক্তিকে উপেক্ষা করা কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই দীর্ঘমেয়াদে সম্ভব নয়।
রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠলে আন্তর্জাতিক সমাজ সাধারণত দুটি বিষয় খতিয়ে দেখে—এক, অভিযুক্ত রাষ্ট্র স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তে সহযোগিতা করছে কি না; দুই, ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঠেকাতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রমাণ দিচ্ছে কি না। এই দুই ক্ষেত্রেই ভারতের অবস্থান এখনো অস্পষ্ট ও প্রতিরক্ষামূলক। অভিযোগ অস্বীকার করা একটি রাষ্ট্রের অধিকার, কিন্তু একই সঙ্গে স্বচ্ছতা ও সহযোগিতার অভাব আস্থার সংকটকে আরও ঘনীভূত করে।
শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড তাই শুধু একজন তরুণ নেতার জীবনাবসান নয়; এটি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বিশ্বাস, ন্যায়বিচার ও রাষ্ট্রীয় আচরণের মানদণ্ড নিয়ে এক গভীর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। যদি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার ও দায় নির্ধারণ আন্তরিকভাবে না হয়, তবে ক্ষত শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এটি আঞ্চলিক সম্পর্ক, কূটনৈতিক ভারসাম্য এবং জনগণের মধ্যে পারস্পরিক আস্থাকে দীর্ঘদিন বিষাক্ত করে রাখবে।
বল এখন সত্যিই ভারতের কোর্টে—এই কথাটি কেবল কূটনৈতিক ভাষ্য নয়, বরং বাস্তবতার প্রতিফলন। স্বচ্ছ তদন্ত, তথ্য বিনিময় এবং আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাই পারে এই সংকটের কিছুটা হলেও সমাধান দিতে। অন্যথায়, ট্রান্সন্যাশনাল রিপ্রেশনের অভিযোগ ভারতের কাঁধে এমন এক বোঝা হয়ে থাকবে, যা তার বৈশ্বিক নেতৃত্বের স্বপ্নকে ক্রমাগত ভারী করে তুলবে।
আপনার মতামত জানানঃ