খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক ব্যতিক্রমী অধ্যায়। একজন গৃহবধূ থেকে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠা—এই যাত্রাপথ শুধু ব্যক্তিগত সাফল্যের গল্প নয়, বরং একটি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক রূপান্তর, আন্দোলন-সংগ্রাম, সংকট ও সমঝোতার দীর্ঘ ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। প্রায় চার দশকের রাজনৈতিক জীবনে তিনি কখনো আপসহীন আন্দোলনের প্রতীক, কখনো ক্ষমতার কেন্দ্রের নেতা, আবার কখনো নিপীড়নের শিকার এক ধৈর্যশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সময়ের প্রবাহে তাঁর ভূমিকা নিয়ে মতভেদ থাকলেও, শেষ পর্যন্ত তিনি হয়ে উঠেছেন এমন এক রাজনৈতিক চরিত্র, যাকে অস্বীকার করা বাংলাদেশের রাজনীতির পক্ষে সম্ভব নয়।
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিএনপি এক গভীর নেতৃত্বসংকটে পড়ে। সেনা অভ্যুত্থান ও অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে দলটি কার্যত দিশাহারা হয়ে ওঠে। সেই অনিশ্চিত সময়ে, ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপিতে যোগ দেন। রাজনীতির সঙ্গে তাঁর পূর্বপরিচয় ছিল না বললেই চলে। তিনি ছিলেন মূলত একজন গৃহবধূ, সংসারকেন্দ্রিক জীবনে অভ্যস্ত। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতা তাঁকে টেনে আনে সামনে। বয়স তখন চল্লিশের নিচে। অনেকেই ভেবেছিলেন, তিনি হয়তো প্রতীকী নেতৃত্বে সীমাবদ্ধ থাকবেন। কিন্তু খুব দ্রুতই তিনি সেই ধারণা ভেঙে দেন।
সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনই খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তি গড়ে দেয়। ১৯৮৩ সাল থেকে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে তিনি ৭–দলীয় ঐক্যজোটের নেতৃত্ব দেন। দীর্ঘ নয় বছরের আন্দোলনে রাজপথ, গ্রেপ্তার, হুমকি—সবকিছুর মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে একজন দৃঢ়চেতা নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এখানেই তাঁর ‘আপসহীন নেত্রী’ পরিচয়ের সূচনা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, এরশাদের পতনে তাঁর নেতৃত্ব ছিল অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি।
১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হয়। সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এটি শুধু একটি ব্যক্তিগত অর্জন ছিল না; মুসলিমপ্রধান ও পুরুষশাসিত সমাজে একজন নারীর নেতৃত্ব গ্রহণ ছিল ঐতিহাসিক ঘটনা। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিনি ছিলেন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী—যা তাঁর রাজনৈতিক কৃতিত্বকে বিশেষ মাত্রা দেয়। তাঁর নেতৃত্বেই রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যায় বাংলাদেশ।
ক্ষমতায় থাকার সময় খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব ছিল একদিকে দৃঢ়, অন্যদিকে পরিস্থিতিবোদ্ধা। তিনি প্রয়োজনে নিজের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করতেও প্রস্তুত ছিলেন। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে প্রথমে বিএনপির আপত্তি থাকলেও, জনদাবির মুখে তিনি সেই ব্যবস্থাকে সংবিধানে যুক্ত করেন। এই সিদ্ধান্ত তাঁর রাজনৈতিক বাস্তববোধ ও সমঝোতামুখী মানসিকতার উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
তবে খালেদা জিয়ার রাজনীতি কেবল আন্দোলন বা রাষ্ট্র পরিচালনায় সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি জোটের রাজনীতিতে একটি স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন। ৭–দলীয় জোট থেকে শুরু করে ৪–দলীয়, পরে ২০–দলীয় জোট—দীর্ঘ সময় ধরে ভিন্নমত ও বিপরীত আদর্শের দলগুলোর সঙ্গে তিনি সমঝোতার রাজনীতি করেছেন। ১৯৯৯ সালে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতসহ ৪–দলীয় জোট গঠন করে ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়া ছিল সেই রাজনীতির বড় উদাহরণ। যদিও সেই সরকারের বিদায় সুখকর ছিল না, তবু জোটভিত্তিক রাজনীতির বাস্তবতা তিনি গভীরভাবে অনুধাবন করতেন।
২০০৭ সালের এক-এগারোর পর খালেদা জিয়ার জীবনে নেমে আসে সবচেয়ে বড় সংকট। সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জরুরি অবস্থা জারি হয়, গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে ও তাঁর দুই ছেলেকে। বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা, তাঁকে বিদেশে পাঠানোর চাপ—সবকিছুর মুখোমুখি হয়েও তিনি দেশ ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান। “এই দেশই আমার ঠিকানা”—এই বক্তব্য তাঁর রাজনৈতিক দৃঢ়তার প্রতীক হয়ে আছে। কারাগারে থাকাকালে কিংবা অবরুদ্ধ অবস্থায় ব্যক্তিগত শোক তাঁকে বারবার আঘাত করেছে—স্বামীর মৃত্যু, মায়ের মৃত্যু, সন্তানের মৃত্যু—সব হারানোর পরও তিনি রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেননি।
আওয়ামী লীগ সরকার আমলে তাঁকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, গুলশানের বাসায় অবরুদ্ধ রাখা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা—এসব ঘটনা তাঁর জীবনের কঠিন অধ্যায়। তবু তিনি ধৈর্য হারাননি। রাজনৈতিক কর্মীদের মতে, এই সময়গুলোতেই তাঁর চরিত্রের আরেকটি দিক স্পষ্ট হয়—অটলতা ও সহনশীলতা। তিনি কম কথা বলতেন, বেশি শুনতেন। দলীয় নেতাদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও তিনি বৃহত্তর স্বার্থে সমঝোতার চেষ্টা করতেন।
শেষ জীবনে এসে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অবস্থান একটি ভিন্ন রূপ নেয়। দীর্ঘ আন্দোলন, ক্ষমতা, নিপীড়ন ও ব্যক্তিগত বেদনার মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাকে দল-মতনির্বিশেষে অনেকে সম্মানের চোখে দেখতে শুরু করেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এখানেই তিনি ‘ঐক্যের প্রতীক’ হয়ে ওঠেন। তরুণদের উদ্দেশে তাঁর আহ্বান—ধ্বংস নয়, প্রতিশোধ নয়, ভালোবাসা ও শান্তির সমাজ গড়ার কথা—এই রূপান্তরেরই প্রতিফলন।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন তাই একরৈখিক নয়। এখানে রয়েছে আপসহীন আন্দোলন, ক্ষমতার বাস্তবতা, সমঝোতার কৌশল, ব্যক্তিগত ত্যাগ ও অবিচলতা। তিনি শুধু একজন ব্যক্তি নন; সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছেন। তাঁর রাজনীতি নিয়ে বিতর্ক থাকবে, সমালোচনাও থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁর উপস্থিতি এমন এক শক্ত রেখা এঁকে দিয়েছে, যা উপেক্ষা করা অসম্ভব। গৃহবধূ থেকে রাষ্ট্রনায়ক—এই যাত্রাপথ তাঁকে কেবল একজন সফল রাজনীতিবিদ নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনিবার্য অধ্যায়ে পরিণত করেছে।
আপনার মতামত জানানঃ