বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এনসিপি, বিএনপি এবং জামায়াতকে ঘিরে যে জটিল সমীকরণ তৈরি হয়েছে, তা দেশের রাজনীতিকে এক নতুন উত্তাপে নিক্ষেপ করেছে। জুলাই আন্দোলনের পর জন্ম নেওয়া এই ছাত্রনেতৃত্বাধীন দল এনসিপি শুরু থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও তাদের ভবিষ্যৎ, অবস্থান, মতাদর্শ ও রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের কৌশল নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্ন জমেছে। ‘ধানের শীষে শাপলা কলি ফুটবে কি না’—এই প্রশ্নটিই আজ প্রাসঙ্গিক, কারণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে জোট ও সমঝোতা কখনোই সরল সমীকরণে কাজ করে না। প্রতিটি দলই নিজেদের স্বার্থ, রাজনৈতিক লক্ষ্য এবং ভবিষ্যৎ অবস্থানকে সামনে রেখে হিসাব–নিকাশ করে। সেক্ষেত্রে এনসিপির এই অদ্ভুত ও কিছুটা দ্রুত উত্থান, এটি ঘিরে থাকা বিতর্ক, বিএনপির শক্তি পুনরুদ্ধার এবং জামায়াতের রাজনৈতিক কৌশল—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল ও বহুস্তরীয় হয়ে উঠেছে।
জুলাই আন্দোলনের আলোকে জনগণ প্রথমবার বুঝতে পেরেছে যে ছাত্ররাই দেশের পরিবর্তন আনতে পারে। কিন্তু সেই শক্তি রাজনৈতিক দলে রূপ নেওয়ার পর কতটা স্থায়ী হতে পারে—এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আন্দোলনে অংশ নেওয়া তরুণরা যখন রাষ্ট্রক্ষমতা নিজের হাতে নিলেন, তখনই অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে ক্ষমতার স্বাদ খুব দ্রুতই তাদের ভিন্ন পথে নিয়ে যাবে। বাস্তবে সেই আশঙ্কা অমূলক নয়। আন্দোলনের কয়েক মাসের মধ্যেই দেখা গেল, যেসব তরুণকে মানুষ পরিবর্তনের প্রতীক ভেবে দেখেছিল, তারা দ্রুত প্রভাব, নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বের রাজনীতিতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। কেউ সরকারি পদ পেয়েছেন, কেউ প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করেছেন, আরেকদল নিজেদের সংগঠন গড়ে সরকারি সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করছেন। এতে এনসিপিকে ‘কিংস পার্টি’ বলার যুক্তি আরও শক্তিশালী হয়।
কিন্তু রাজনীতির অমোঘ সত্য হলো—ক্ষমতার ছায়ায় থাকা আর ক্ষমতার বাইরে রাজনীতি করার অভিজ্ঞতা এক নয়। শুরু থেকে তারা মনে করেছিল, সরকারে তাদের জায়গা প্রাপ্য, কারণ আন্দোলনের বিজয় তাদের হাত ধরেই এসেছে। এর ধারাবাহিকতায় তারা চাপের রাজনীতি করে আসছে এবং সরকারকে নিজেদের দাবি মানতে বাধ্য করেছে। আন্দোলনের নৈতিক শক্তির ওপর ভর করে তারা বিশ্বাস করেছিল যে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হয়ে ওঠা খুব কঠিন নয়। আর এখানেই তাদের প্রথম রাজনৈতিক ভুল। বাস্তবে দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক শক্তি, ভোটব্যাংক, নেতাকর্মী, তৃণমূল উপস্থিতি, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা—এসব ছাড়া কোনো দল রাতারাতি জাতীয় সমীকরণে প্রতিষ্ঠা পায় না। এনসিপি সেই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে সময় নিয়েছে। অতএব প্রভাব থাকলেও এটি মূলত ছিল একটি কাগুজে শক্তি—যার সঙ্গে ছাত্র আন্দোলনের আবেগ ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক পরিপক্কতা ছিল না।
জামায়াতের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা এবং সহযোগিতা আরও বাড়িয়ে দিল পরিস্থিতির জটিলতা। জামায়াত দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয় ও বিতর্কিত অবস্থানে ছিল। কিন্তু এনসিপির সঙ্গে যুক্ত হয়ে তারা যেন নতুন জীবন পেল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিবিরের উপস্থিতি আবারও চোখে পড়তে শুরু করল। তরুণ ভোটারদের মধ্যে যেটুকু গ্রহণযোগ্যতা তারা হারিয়েছে বলে মনে করেছিল—সেটিও আংশিকভাবে ফিরে আসল। এর বিপরীতে এনসিপির অর্জন ছিল তুলনামূলকভাবে সামান্য। তারা ভেবেছিল, জামায়াতকে পাশে নিয়ে বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ জানানো সহজ হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—জামায়াত এনসিপির শক্তি ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থান মজবুত করল, আর এনসিপি বিভ্রান্তি, সমালোচনা ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলল।
এদিকে বিএনপির রাজনৈতিক দরপতন ও পুনরুত্থানও পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ডাকসু–রাকসু নির্বাচনে হারার পর বিএনপির প্রতি যে হতাশা তৈরি হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে কাটিয়ে দলটি পুনরায় রাজনৈতিক লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরে এসেছে। তাদের সাংগঠনিক শক্তি, জনভিত্তি এবং তৃণমূল উপস্থিতি আরও দৃঢ় হয়েছে। ফলে এনসিপির সামনে একটি কঠিন বাস্তবতা দাঁড়িয়েছে—তারা বিএনপির বিকল্প হতে পারেনি, বরং বিএনপি আবারও এক নম্বর প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই এনসিপি বুঝতে পারছে যে জামায়াতের সঙ্গে মিত্রতা তাদের জন্য রাজনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। জনগণের কাছে তারা আর স্বাধীনতার প্রতীক নয়, বরং ক্ষমতা-নির্ভর ও চাপের রাজনীতি করা একটি দল। এ অবস্থায় বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়া তাদের জন্য কৌশলগতভাবে জরুরি হয়ে উঠেছে। কিন্তু সমস্যাটি এখানেই—বিএনপি যে আসনগুলোতে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে, সেই আসনেই আবার এনসিপির নেতারাও প্রার্থী হতে চান। অর্থাৎ উভয় পক্ষের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত বেশ স্পষ্ট।
এছাড়া সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ২০টি আসন ও ৩টি মন্ত্রিত্বের দাবি—এটি আরও এক অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছে। যদিও এনসিপি তা অস্বীকার করেছে এবং দাবি করেছে তারা ৩০০ আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতায় এমন বক্তব্য সাধারণত কৌশলগত চাপ তৈরির অংশ। কারণ একটি নতুন দলের পক্ষে ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রায় অসম্ভব। বরং তারা বিএনপিকে চাপ দিয়ে নিজেদের জন্য সুবিধাজনক আসন ও প্রভাব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে—এমনটাই স্পষ্ট।
এখন প্রশ্ন হলো, এই সমীকরণে লাভ কার, ক্ষতি কার? বিএনপির জন্য এনসিপির সঙ্গে সমঝোতা যেমন সুযোগ তৈরি করতে পারে, তেমনি ঝুঁকিও তৈরি করতে পারে। সমঝোতা হলে নির্বাচনে বিএনপির জয় বাড়তে পারে। জুলাই আন্দোলনের তরুণ সমর্থকরা এনসিপির আহ্বানে বিএনপির দিকে ঝুঁকতে পারে। এতে ভোটের অঙ্কে সুবিধা পাওয়া সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হলো—ক্ষমতায় গেলে এনসিপি আবার প্রভাব বিস্তার করতে চাইবে, যা ভবিষ্যতে বিএনপির জন্য ‘সরকারের মাঝে সরকার’ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। এর আগের উদাহরণও আছে, এবং সে অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।
অন্যদিকে এনসিপির জন্য বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা ভীষণ লাভজনক হতে পারে। এতে তারা তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবে, সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে, এবং রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে নিজেদের শক্তি বাড়ানোর সুযোগ পাবে। তাছাড়া আন্দোলনের নৈতিক শক্তির ওপর ভর করে তারা যে চাপের রাজনীতি করতে চেয়েছিল—এটিও আংশিকভাবে সম্ভব হবে। কিন্তু এ সমঝোতায় বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে দীর্ঘমেয়াদে। কারণ এনসিপি পরবর্তী নির্বাচনে আরও শক্তিশালী হয়ে দ্বিতীয় বৃহৎ দল হওয়ার লক্ষ্যে এগোতে পারে, যা বিএনপির স্থায়ী প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি করবে।
এই প্রেক্ষাপটে ‘ধানের শীষে শাপলা কলি ফুটবে কি না’—এর উত্তর এখনো অস্পষ্ট। রাজনীতির হিসাব বদলায় দ্রুত, এবং বাংলাদেশে এই পরিবর্তন আরও হঠাৎ ঘটে থাকে। জুলাই আন্দোলনের পর খুব অল্প সময়ে যে তরুণরা ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে, তারা এখন বাস্তব রাজনীতির কঠিন পাঠ শিখছে। জনগণের সমর্থন ধরে রাখা, নৈতিক অবস্থান বজায় রাখা, এবং দীর্ঘমেয়াদে বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক দল হয়ে ওঠা—এই তিনটি বিষয় এখন এনসিপির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এনসিপির তরুণ নেতৃত্বের বয়স, শক্তি এবং সম্ভাবনা অবশ্যই আছে। তারা আগামী পঞ্চাশ বছর বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ রাখতে পারে। কিন্তু তড়িঘড়ি করে ক্ষমতা চাওয়ার প্রবণতা, চাপের রাজনীতি, আদর্শিক অস্পষ্টতা এবং সাংগঠনিক দুর্বলতা—এসব মিলিয়ে তারা নিজেদের অবস্থান দুর্বল করেছে। দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে হলে তাদের আচরণ, ভাষা, সংগঠন এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিপক্কতা আনতেই হবে।
শেষ পর্যন্ত বলা যায়, শাপলা কলি ধানের শীষে ফুটবে কি না—এটি আগামী কিছু মাসের রাজনৈতিক সমঝোতা, দলগুলোর সিদ্ধান্ত, ভোটযুদ্ধ, জোট–সংকট এবং ক্ষমতার কৌশলের ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট—বাংলাদেশের রাজনীতিতে তরুণদের উত্থান আবারও আলোচনায় এসেছে, এবং এই উত্থান সঠিক দিক পেলে দেশের রাজনীতিকে নতুন পথে নিতে পারে। আর ভুল পথে গেলে তারা হারিয়ে যাবে পূর্বের অনেক ছাত্র-রাজনৈতিক শক্তির মতোই। ভবিষ্যতের গল্প এখনো লেখা হয়নি। তবে রাজনৈতিক বাস্তবতা বলছে—যে দল ধৈর্য, অভিজ্ঞতা এবং জনগণের আস্থা অর্জনের দিকে মনোযোগ দেবে, তারাই দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিকে থাকবে। এনসিপি সেই পরীক্ষার মধ্যেই আছে।
আপনার মতামত জানানঃ