ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক এরশাদ হালিমকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে গ্রেপ্তার এবং পরবর্তী সময়ে আদালত কর্তৃক কারাগারে পাঠানোর ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন, শিক্ষক–শিক্ষার্থী সমাজ এবং বৃহত্তর জনমতকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছে। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ধীরে ধীরে জমা হলেও বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতে সময় লেগেছে। কিন্তু যখন এক শিক্ষার্থী প্রকাশ্যে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরলেন, তখন তা যেন আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হয়ে চারদিকে আলোচনার ঢেউ তুলল। সমাজমাধ্যমে ক্ষোভ ও অপেক্ষমান ক্রোধ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। অবশেষে আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং পুলিশ তাঁকে নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করে। আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাঁকে কারাগারে পাঠান—যা অনেকের কাছে ন্যায়বিচারের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে হয়েছে।
ঘটনার শুরু গত বৃহস্পতিবার রাতে। রাজধানীর শেওড়াপাড়ার নিজ বাসায় অধ্যাপক এরশাদ হালিমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একই রাতে এক শিক্ষার্থী তাঁর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়ন এবং শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ এনে মিরপুর মডেল থানায় মামলা করেন। মামলার বর্ণনায় শিক্ষার্থী জানান, পরীক্ষাসংক্রান্ত একটি সমস্যায় তিনি পড়েছিলেন এবং তা সংশোধনের প্রলোভন দেখিয়ে তাঁকে বাসায় ডেকে নেয়া হয়। প্রথমে আলাপের একপর্যায়ে শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়ন করা হয় এবং এরপর ভয় দেখানো হয় যাতে বিষয়টি প্রকাশ না পায়। কিন্তু শুধু একবার নয়, অভিযোগ অনুযায়ী, কয়েকবার ওই শিক্ষার্থীকে ভয়–ভীতি প্রদর্শন করে বাসায় ডেকে নিয়ে যৌন নিপীড়ন ও মারধর করা হয়। শিক্ষার্থী নিজের অভিজ্ঞতা নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তুলে ধরার পর ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
বলা হয়ে থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়কে সমাজের আলোকবর্তিকা এবং মননশীলতার কারখানা বলা হয়। তারই একটি সুপ্রাচীন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের ওপর এ ধরনের অপরাধ করেন, তবে তা কেবল ব্যক্তিগত অপরাধ নয়; বরং চারপাশের বিশ্বাসভূমি, আস্থা এবং নিরাপত্তাবোধ ভেঙে দেয়। তাই অভিযোগ ওঠার পরই রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা সোচ্চার হয়ে ওঠেন। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একের পর এক পোস্ট করে ঘটনার বিবরণ দেন। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা—টিএসসির সাংবাদিক সমিতিতে একদল শিক্ষার্থী সংবাদ সম্মেলন করেন, যেখানে তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
সংবাদ সম্মেলনে উঠে আসে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। রসায়ন বিভাগের বিভিন্ন সময়ের বহু শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন যে এরশাদ হালিমের অনৈতিক আচরণ নতুন কিছু নয়। বহু বছর ধরেই তিনি নানাভাবে শিক্ষার্থীদের হয়রানি করেছেন। রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী এবং ফজলুল হক মুসলিম হল সংসদের সহসভাপতি আবু নাঈম জানান, অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পর অন্তত ১২ জন শিক্ষার্থী তাঁদের কাছে এসে নিজেদের নিপীড়নের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। প্রত্যেকেই নাকি ভয়, সামাজিক চাপ বা ভবিষ্যতের ক্ষতির আশঙ্কায় এত দিন কথা বলতে পারেননি। তাঁর দাবি, প্রতিদিনই নতুন কেউ না কেউ তাঁর বা অন্য সহপাঠীদের কাছে এসে আরও তথ্য দিচ্ছেন। কতজন শিক্ষার্থী প্রকৃতপক্ষে তাঁর নিপীড়নের শিকার হয়েছেন—তা কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা দিয়ে বলা যাচ্ছে না, তবে শিক্ষার্থীরা জানান যে সংখ্যাটা হয়তো আরও বেশি হতে পারে।
ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনও নড়েচড়ে বসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদ জানান, অভিযোগ পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অভিযোগটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলে পাঠানো হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীরা মনে করেন, এত বছর ধরে অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সঠিক সময়ে পদক্ষেপ না নেওয়ায় একজন শিক্ষক অবাধে অনৈতিক কাজ করতে পেরেছেন। তাঁরা এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংগঠনিক কাঠামোর একটি ব্যর্থতা হিসেবেও উল্লেখ করছেন।
শুক্রবার সকালে অধ্যাপক এরশাদ হালিমকে আদালতে হাজির করা হলে তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে কারাগারে রাখার আবেদন জানান। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী জামিন চান এবং দাবি করেন তাঁর মক্কেল নির্দোষ। তিনি যুক্তি দেন, তাঁর মক্কেল বিভাগের প্রধান হওয়ার পথে ছিলেন এবং এ কারণে সহকর্মীরা তাঁকে ফাঁসিয়েছে। তিনি আরও জানান, এরশাদ হালিমের স্ত্রী ও অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া সন্তান আছে, তাই তিনি এ ধরনের অপরাধে যুক্ত হতে পারেন না। কিন্তু বিচারক যুক্তি গ্রহণ করেননি। আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। অনেকেই বলেন, সমাজে ক্ষমতাশালী লোকেরা অনেক সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে দায়িত্বের সুযোগ নিয়ে দুর্বলদের ওপর অত্যাচার চালান। বিশেষ করে শিক্ষক হলে তাঁর প্রতি শিক্ষার্থীদের একটা স্বাভাবিক বিশ্বাস ও আনুগত্য থাকে—যা অপব্যবহার করা হলে তা অত্যন্ত ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। এ ধরনের অপরাধ শুধু ব্যক্তিগত মর্যাদাহানিই করে না, বরং শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে ভেঙে দেয়। তাছাড়া এসব ঘটনা প্রকাশ্যে এলেও বিভিন্ন সময় সামাজিক লজ্জাবোধ, ভবিষ্যৎ শঙ্কা এবং ক্ষমতাবানদের প্রতিশোধের ভয় শিক্ষার্থীদের মুখ খুলতে দেয় না।
সংবাদ সম্মেলনে অন্য শিক্ষার্থীরাও বলেন, এরশাদ হালিম প্রথমে শিক্ষার্থীদের নিজের অফিসকক্ষে ডাকতেন। তারপর ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতার ভান করে তাঁদের বাসায় ডাকতেন। গভীর রাতে ফোন করে অসংলগ্ন কথা বলতেন। এসব আচরণে শিক্ষার্থীরা অস্বস্তি বোধ করতেন। কিন্তু তিনি শিক্ষক হওয়ায় তাঁরা তা প্রকাশ করতে ভয় পেতেন। বিশেষ করে নতুন ব্যাচের শিক্ষার্থীরা মনে করতেন, কোনো সমস্যা হলে এই শিক্ষক তাদের নম্বর ও ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলতে পারেন। এ কারণেই বহু শিক্ষার্থী চুপ থাকতেন।
অভিযোগকারীদের মধ্য থেকে একজন শিক্ষার্থী তাঁর অভিজ্ঞতা ফেসবুকে তুলে ধরেন। তিনি জানান, পরীক্ষায় ভুল সংশোধনের কথা বলে তাঁকে বাসায় ডাকা হয় এবং সেখানেই প্রথমবার তিনি যৌন নিপীড়নের শিকার হন। বিষয়টি যাতে প্রকাশ না পায়, সে জন্য ভয় দেখানো হয়। এমনকি পরে একাধিকবার বাসায় ডেকে নিয়ে তাঁকে নির্যাতন করা হয়। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে গেলে অসংখ্য শিক্ষার্থী তাঁর সমর্থনে এগিয়ে আসেন এবং অনেকে নিজ নিজ অভিজ্ঞতা ভাগ করেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দাবি আরও জোরালো হয়। তাঁরা শুধু গ্রেপ্তার নয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের দাবি জানান। তাঁদের মতে, একজন শিক্ষক যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে নিরাপদ রাখতে না পারেন, বরং তাঁরাই হয়ে উঠেন নির্যাতনকারী—তাহলে তাঁর মতো শিক্ষক শিক্ষাঙ্গনের জন্য ভয়ংকর। শিক্ষার্থীরা এমন শিক্ষকের কাছে আর কোনো শিক্ষার্থীকে ঝুঁকিতে রাখতে রাজি নন। রসায়ন বিভাগের ২০২২–২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী অভীক চক্রবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীরা আগেও তাঁদের এই শিক্ষক সম্পর্কে সাবধান করেছিলেন। কিন্তু তখন তাঁরা বিষয়টি গভীরভাবে নেননি। এখন বুঝতে পারছেন, শঙ্কার পিছনে যথেষ্ট কারণ ছিল।
পুরো ঘটনায় সবচেয়ে উদ্বেগের জায়গাটি হলো—এত বছর ধরে অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বিষয়টি কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কারও নজরে আসেনি? কোন সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে শিক্ষার্থীরা এতদিন চুপ ছিলেন? কেন তাঁরা মনে করেছিলেন যে কথা বললে তাঁদেরই ক্ষতি হবে? শিক্ষার্থীদের এ নীরবতা শুধু একটি ব্যক্তিগত অপরাধীর কারণে নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক ভয়ের কারণে তৈরি হয়েছে—যা সমাজে ক্ষমতার ব্যবহারের দিকগুলোকে ভয়াবহভাবে তুলে ধরে।
এই ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের ভেতরে শিক্ষার্থী–শিক্ষকের সম্পর্কের একটি অন্ধকার দিক উন্মোচিত করেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার, মানসিক চাপ, ভয় দেখানো এবং নির্যাতনের এই বাস্তবতা দেখিয়ে দিয়েছে যে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ অভিযোগ ব্যবস্থার ওপর শিক্ষার্থীদের ভরসা কমে গেছে। তাই শিক্ষার্থীরা আরও শক্তিশালী, নিরপেক্ষ এবং দ্রুত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার দাবি তুলছেন। তাঁরা চান, ভবিষ্যতে কোনো শিক্ষার্থী যেন এমন পরিস্থিতির শিকার না হন।
অধ্যাপক এরশাদ হালিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁর উপযুক্ত শাস্তি হওয়াই ন্যায়বিচারের দাবি। তবে তার চেয়েও বড় বিষয় হলো—এ ধরনের ঘটনা যেন আর কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুনরাবৃত্তি না ঘটে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং মানসিক সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। এই ঘটনা তাই শুধু একটি অপরাধ নয়; বরং এটি উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরকার দুর্বলতা, বিশ্বাসভঙ্গ এবং ক্ষমতাবানদের জবাবদিহির প্রয়োজনীয়তার এক নির্মম স্মারক। এখন সবার দৃষ্টি আইনের দিকে—আদালত, তদন্ত সংস্থা এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কীভাবে বিষয়টি সামাল দেয়, তা-ই ঠিক করবে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে কতটা নিরাপদ অনুভব করবেন।
আপনার মতামত জানানঃ