
যাত্রীদের বিরুদ্ধে অনৈতিক আচরণের অভিযোগে গত শুক্রবার রাতে মুন্সিগঞ্জ ঘাটে একটি লঞ্চে ভাংচুর চালায় স্থানীয় জনতা। ওই সময় লঞ্চের দুই তরুণীকে শত শত মানুষের সামনে মারধর করেন নেহাল আহমেদ ওরফে জিহাদ নামের এক যুবক।
যাত্রীদের বিরুদ্ধে অনৈতিক আচরণের অভিযোগে গত শুক্রবার রাতে মুন্সিগঞ্জ ঘাটে একটি লঞ্চে ভাংচুর চালায় স্থানীয় জনতা। ওই সময় লঞ্চের দুই তরুণীকে শত শত মানুষের সামনে মারধর করেন নেহাল আহমেদ ওরফে জিহাদ নামের এক যুবক। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ অভিযুক্ত যুবককে আটক করে। পরবর্তী সময়ে নৌ পুলিশ বাদী হয়ে জিহাদসহ অজ্ঞাতনামা ২০-২৫ জনকে আসামি করে মামলা করে।
শুধু এ ঘটনাই নয়, বিগত কয়েক মাসে নারীর প্রতি এমন একাধিক সহিংসতার ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। এ সময়ে ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের অন্য ঘটনাও বেড়েছে। পুলিশের অপরাধ পরিসংখ্যানের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শুধু গত এপ্রিলে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২ হাজার ৮৯টি। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের পর ৩২ মাসের মধ্যে এ সংখ্যা সর্বোচ্চ। এছাড়া ২০২৪ সালের শেষ চার মাসের সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে ১ হাজার ২১৮টি। ২০২৪ সালের শেষ চার মাসে ৫ হাজার ৭৯৫টি নারী ও শিশু নির্যাতনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল আর ২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ১৩-তে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশের অপরাধ পরিসংখ্যানে উঠে আসা তথ্যের তুলনায় বাস্তব পরিস্থিতি আরো খারাপ। প্রতিনিয়ত এমন অনেক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে যেগুলো সামনে আসছে না।
এমনই একজন ভুক্তভোগী সায়মা রহমান (ছদ্মনাম)। রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সায়মা গত বৃহস্পতিবার বাড্ডায় বাস থেকে নামার সময় এক তরুণের অপ্রীতিকর স্পর্শ ও মন্তব্যের শিকার হন। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হেনস্তার ভয়ে এ ঘটনায় তিনি এখনো কোনো আইনি পদক্ষেপ নেননি। সায়মা বলেন, ‘আমি তাৎক্ষণিকভাবে হতভম্ব হয়ে যাই, কী করব বুঝতে পারছিলাম না। একটু স্বাভাবিক হতে হতে ছেলেটা ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যায়। আমি এ রাস্তায় প্রায় তিন বছর ধরে যাতায়াত করছি, কিন্তু কখনো এমনটি ঘটেনি। ওই ঘটনার পর থেকে আমি মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছি।’
সায়মা আরো বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনায় প্রতিবাদ করতে গেলে এখন নারীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরো বেশি হেনস্তার শিকার হতে হয়। এসব কারণে আইনি পদক্ষেপ নেয়ারও সাহস পাচ্ছি না।’
২০২৪ সালের প্রথম চার মাসের পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিলে দেখা যায় ওই সময়ের তুলনায়ও চলতি বছরের প্রথম চার মাসে নারীর প্রতি অপরাধ বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় ২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে ১ হাজার ৪৬৭টি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা বলেন, ‘সমাজের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো থেকে সরিয়ে দিয়ে নারীকে ঘরবন্দি করার চেষ্টা করছে একটি মহল। তারা একটি ত্রাস তৈরি করতে চাচ্ছে, যাতে নারী মনে করে ঘরে থাকাটাই তার জন্য নিরাপদ। কিন্তু তারা এটি বুঝতে পারছে না যে নারী যদি ঘরে থাকে তবে দেশ অর্থনৈতিকভাবে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর সবচেয়ে হতাশাজনক হলো আমরা যে তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে আশাবাদী হয়েছিলাম, তাদের কেউ কেউ এ মহলটির পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের দেশে বিচারিক প্রক্রিয়া সহজ নয়। এটি একই সঙ্গে ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। আর নারীদের ক্ষেত্রে বিষয়টা আরো কঠিন। সমাজ-পরিবার বেশির ভাগ সময় বোঝানোর চেষ্টা করে হেনস্তা কিংবা নির্যাতনের শিকার হওয়ার জন্য মেয়েটিই দায়ী এবং বিচার চাইতে গেলে সামাজিকভাবে তাদের আরো বেশি সম্মানহানি ঘটবে। এসব কারণে ভুক্তভোগীদের একটি বড় অংশ নির্যাতিত হয়েও চুপ থাকেন।’
বিগত কয়েক মাসে আলোচিত কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুক্তভোগী নারীকেই দোষারোপ করা হয়েছে।
রাজধানীর বনশ্রীতে ২ এপ্রিল রাতে এক নারী সাংবাদিক হেনস্তা ও মারধরের শিকার হন। ওই নারী সাংবাদিক তার ছোট ভাইকে নিয়ে জুসের দোকানে গিয়েছিলেন। এ সময় এক ব্যক্তি প্রথমে তার সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন এবং পরে কয়েকজন যুবক এসে তাকে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন। নারী সাংবাদিকের ছোট ভাই প্রতিবাদ করলে তাকে মারধর করে ওই যুবকরা। এ সময় ওই নারী বাধা দিতে গেলে ১০-১২ জন যুবক মিলে তাকে মারধর এবং শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন।
ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী নারী সংবাদকর্মীর মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তিনজনকে আটক করা হয়। কিন্তু ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ওই নারী সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ফেসবুকে নানা আপত্তিকর কথা লেখা হয়। এ ঘটনায় আটককৃতরা এক সপ্তাহ পর জামিন পেয়েছেন।
ভুক্তভোগী নারী সাংবাদিক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এবং সাংবাদিক পরিচয়ের কারণে আমি অনেক জায়গায় তুলনামূলক বেশি সহযোগিতা পেয়েছি। অনেক মানুষ আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন কিন্তু এর পরও আমাকে যে মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে সেটি বর্ণনাতীত। হেনস্তাকারীদের পক্ষে একটি গ্রুপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাকে নিয়ে নানারকম কুরুচিপূর্ণ কথা ছড়িয়েছিল, আমার মানহানির চেষ্টা করেছে, আমার এলাকায় অবধি আমাকে নিয়ে বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়েছে, আমার নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার চেষ্টা হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি নিজের সামাজিক অবস্থানের কারণে কিছুটা এগিয়ে থাকার পরও যদি এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে বোঝাই যায় সমাজে অনগ্রসর শ্রেণীর মেয়েদের অবস্থা কতটা ভয়াবহ।’
এর আগে গত ৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে তার ক্যাম্পাসেই পোশাক নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের জেরে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সহকারী বাইন্ডার মোস্তফা আসিফকে শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে এ ঘটনাতেও দেখা গেছে একদল মানুষ তার সমর্থনে রাস্তায় নেমে এসেছেন। পরে ৬ মার্চ আদালত মোস্তফা আসিফের জামিন মঞ্জুর করলে তারা আসিফকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেন।
নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ ধরনের অপরাধের বড় কারণ আমরা এতদিনেও এমন কোনো সিস্টেম দাঁড় করাতে পারিনি, যেখানে নারী যেকোনো অবস্থায় নিরাপদ থাকবে। আমাদের এখানে আইন এখনো সবার জন্য সমান নয়, এখানে ক্ষমতায় থাকলে তার জন্য এক ধরনের ব্যবস্থা আর ক্ষমতায় না থাকলে আরেক ব্যবস্থা। তাছাড়া অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীল হয়নি। নারীকে যেহেতু দুর্বল বিবেচনা করা হয়, তাই এমন পরিস্থিতিতে তারা তুলনামূলক বেশি নিগ্রহের শিকার হচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এ পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে হলে আমাদের সিস্টেমকে শক্তিশালী করতে হবে। ক্ষমতার প্রয়োগ বন্ধ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং মানুষ যেন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।’
বাংলাদেশে পুলিশ কর্তৃক প্রকাশিত অপরাধ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত নয় মাসে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ১৩ হাজার ৮৮০টি। এর মধ্যে এ বছরের মার্চ ও এপ্রিলে সর্বোচ্চসংখ্যক নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন, ‘যেকোনো দেশে অভ্যুত্থানের পর স্বাভাবিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ফিরে আসতে কিছুটা সময় লাগে; বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে আমাদের দেশের বড় সমস্যা হলো গত ১৫ বছরে রাষ্ট্রের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর ও ক্ষয়িষ্ণু করে ফেলা হয়েছে, বিশেষ করে পুলিশ বাহিনী, যারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আগের সরকার এমনভাবে এ বাহিনীকে ব্যবহার করেছে যে জনগণ তাদের ওপর আস্থা হারিয়েছে। পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। পুলিশ সদস্যরা এখনো মনোবল নিয়ে দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ প্রস্তুত নয়; তারা আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত। ফলে অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীরা এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। পাশাপাশি কিছু গোষ্ঠী অন্যদের ওপর ‘মোরাল পুলিশিংয়ের চেষ্টা করছে। তবে আশার কথা হলো সরকার ও সমাজের অধিকাংশ মানুষ এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন না।’
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ১০ মার্চ ২০২৫ থেকে হটলাইন চালু করেছে, যাতে দ্রুততার সঙ্গে ভিকটিমকে আইনগত সহযোগিতা প্রদান করা যায়। নারী নির্যাতনের ঘটনা এবং সংশ্লিষ্ট মামলা পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে থাকে। প্রতিটি থানায় নারী ও শিশু সার্ভিস ডেস্ক রয়েছে, যেখানে আগত সেবাপ্রত্যাশীদের নারী পুলিশের মাধ্যমে সেবা প্রদান করা হয়। এর পাশাপাশি আমাদের পুলিশ সদস্যরা যখন মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের সভা, উঠান বৈঠক, ওপেন হাউজ ডে করেন তখন কমিউনিটিকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ বিষয়ে সচেতন করা হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সবার সমন্বিত ভূমিকা অপরিহার্য। এক্ষেত্রে সামাজিক, পারিবারিক মূল্যবোধ জোরালো ভূমিকা রাখে।’
আপনার মতামত জানানঃ