
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত দীর্ঘদিন ধরে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে বন্দি হয়ে পড়েছিল, যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সামিট গ্রুপ। বিদ্যুতের প্রকৃত চাহিদাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্ন সময়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। অথচ এ প্রকল্পগুলোর অনেকগুলো দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অপরিহার্য ছিল না। ফলে, চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্র নির্মাণ করা হয় এবং এসব কেন্দ্র উৎপাদনে না গিয়েও সরকারের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করে।
এই প্রক্রিয়ায় ২০১০ সালে দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বিশেষ বিধান পাস করা হয়, যাতে টেন্ডার ছাড়াই প্রকল্প অনুমোদনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সামিট, ইউনাইটেড, বারাক, সিনহা গ্রুপসহ অনেক প্রতিষ্ঠান প্রকল্প লাভ করে। বাস্তবে দেখা গেছে, অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হয় অব্যবহৃত থেকেছে, নয়তো সীমিত উৎপাদন করেছে। তবুও সরকারের চুক্তি অনুযায়ী তাদের শত শত কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। শুধু ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সামিট গ্রুপ পেয়েছে ৪৪০৬ কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ। ১৫ বছরের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটি বিদ্যুৎ খাত থেকে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করেছে।
সামিট গ্রুপের সাফল্যের মূল পেছনে ছিল রাজনৈতিক যোগাযোগ। চেয়ারম্যান আজিজ খান এবং তাঁর কন্যা আয়েশা আজিজ খান সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সজীব ওয়াজেদ জয় নিয়মিত সিঙ্গাপুরে গিয়ে তাঁদের বাসায় থাকতেন। এর ফলে আজিজ খান কোনো রাজনৈতিক পদে না থেকেও ভিভিআইপি মর্যাদা ভোগ করতেন এবং বিদ্যুৎ খাতের বড় বড় সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার করতেন।
কেবল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নয়, জ্বালানি আমদানিতেও এই প্রভাব বিস্তার হয়। ২০১৩ সালে আইন ভঙ্গ করে সামিটকে বছরে এক লাখ টন ফার্নেস অয়েল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। শুধু অনুমতি নয়, তাদের কর মওকুফ করা হয় এবং সরকারের পক্ষ থেকে ৯ শতাংশ সার্ভিস চার্জ প্রদান করা হয়। তদন্তে বের হয়, সামিট আমদানি করা তেলের দামে ওভার ইনভয়েসিং করে বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করেছে। একই সময়ে বিপিসি যে দামে তেল কিনেছে, সামিট সেটির দেড় গুণ দাম দেখিয়ে আমদানি করে।
এর পাশাপাশি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণেও একই ধারা অনুসৃত হয়। মহেশখালীতে দায়মুক্তি আইনের আওতায় সামিট একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করে। শর্ত অনুযায়ী টার্মিনাল অচল থাকলেও প্রতি মাসে প্রায় ৯০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে। এতে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় বেড়েছে বহুগুণ।
সরকার পরিবর্তনের পর এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতিমধ্যে ১৯১টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়েছে, যেখানে প্রায় ৪২ কোটি টাকার বেশি জমা ছিল। আদালতের আদেশে এসব হিসাব অবরুদ্ধ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি লুক্সেমবার্গে আজিজ খান ও তাঁর পরিবারের নামে থাকা কোম্পানির শেয়ার এবং সম্পদ জব্দের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর মূল্য প্রায় ৫৬ কোটি টাকা।
এই অনুসন্ধানগুলো স্পষ্ট করে যে, বিদ্যুৎ খাতকে পরিকল্পিতভাবে একটি গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল, যারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পদে রূপান্তর করেছে। বিদেশে অর্থ পাচার, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং তেল আমদানিতে অনিয়মের মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রীয় অর্থ লুট করেছে। বিদ্যুৎ খাতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের ফলে বিপিডিবি এখন আর্থিক সংকটে পড়েছে এবং সাধারণ ভোক্তাদের ওপর চাপ বেড়েছে।
এখন প্রশ্ন থেকে যায়—দুদক ও আদালতের পদক্ষেপগুলো কতটা কার্যকর হবে, এবং এই দুর্নীতির পেছনে থাকা পুরো চক্রকে কতটা আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। যদি কার্যকর তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, তবে দেশের বিদ্যুৎ খাতে দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও দুর্নীতির আসল চেহারা উন্মোচিত হবে।
আপনার মতামত জানানঃ