৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে রাজনীতির অঙ্গন ও প্রশাসনিক কাঠামোতে যে আমূল পরিবর্তন এসেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীর গ্রেফতার ও পরবর্তী জামিনে মুক্তি। একসময় যারা ক্ষমতার চূড়ায় ছিলেন, তাঁরা এখন আইনের কাঠগড়ায়, কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের বড় একটি অংশ আবারও স্বাধীনভাবে বাইরে চলাফেরা করছেন। এই দ্রুত মুক্তি, বিশেষ করে যাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, নাশকতা ও রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ রয়েছে, তা কেবল আইনি নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
জুলাই আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতার ওপর চালানো সহিংসতা, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র, নাশকতা ও উসকানির অভিযোগেও একাধিক মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় হাজার হাজার গ্রেফতার হলেও কয়েক মাসের মধ্যেই প্রায় ৭০ শতাংশ আসামি জামিনে মুক্ত হয়ে যায়। জেলা পর্যায়ে এই হার আরও বেশি, কোথাও কোথাও ৯০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এমন এক সময়ে যখন দেশ নির্বাচনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, তখন এই জামিনপ্রাপ্তদের পুনরায় সংগঠিত হওয়া বা রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক সূত্র বলছে, ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত অনেককেই গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে থাকা প্রমাণ ও সাক্ষ্য সত্ত্বেও অধিকাংশই আদালত থেকে জামিন পেয়ে গেছে। প্রসিকিউশন বা রাষ্ট্রপক্ষের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। আদালতে জামিন ঠেকানোর ক্ষেত্রে তারা আদৌ কার্যকর ভূমিকা রাখছে কি না, সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন অনেকে। বিশেষ করে আদালতের শুনানিতে তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রতিবেদন, রাজনৈতিক তদবির, অর্থনৈতিক লেনদেন এবং প্রভাবশালী মহলের সুপারিশ অনেক সময় জামিনের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে—এমন অভিযোগও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
এই প্রেক্ষাপটে শরিফ ওসমান হাদির ওপর হত্যাচেষ্টার ঘটনা নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। জুলাই আন্দোলনের অন্যতম মুখ ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক হাদির ওপর খুব কাছ থেকে গুলি চালানো হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, হামলাকারী ফয়সাল নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য ছিল। গত বছর অস্ত্রসহ গ্রেফতার হওয়া সত্ত্বেও মাত্র দুই মাসের মধ্যে সে জামিনে মুক্তি পায়। ফলে প্রশ্ন উঠেছে—যদি সে সময় ফয়সাল কারাগারে থাকত, তাহলে কি এই হামলা ঘটত? অনেকের মতে, এটি প্রমাণ করে যে আইনি ব্যবস্থার ফাঁকফোকর ব্যবহার করে অপরাধীরা দ্রুত বেরিয়ে আসছে এবং আবারও সংগঠিত হয়ে সহিংসতায় জড়াচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, ফয়সালের মতো আরও বহু দোসর জামিনে মুক্ত হয়ে আত্মগোপনে থেকে রাজনৈতিক পুনর্গঠনের চেষ্টায় লিপ্ত। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, তারা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীলতা তৈরির পরিকল্পনা করছে। শেখ হাসিনাসহ বিদেশে অবস্থানরত প্রভাবশালী নেতাদের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়ে মাঠপর্যায়ে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। এসব তৎপরতা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আবারও নাজুক করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, “প্রসিকিউশন প্রতিটি মামলাতেই জামিনের বিরোধিতা করে, কিন্তু শেষ সিদ্ধান্ত আদালতের।” তাঁর মতে, আদালত জামিন দেয় বিভিন্ন বিবেচনায়—বয়স, অসুস্থতা, তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদন বা রাজনৈতিক পরিচয়—যা কখনও কখনও মামলার গুরুত্বকে ছাপিয়ে যায়। এ ছাড়া কিছু ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তা ও আসামির মধ্যে সমঝোতার অভিযোগও রয়েছে, যা জামিন প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করে দেয়।
পা হারানো জুলাই যোদ্ধা আব্দুল্লাহ আহমাদ বলেন, “ফ্যাসিবাদের সহযোগীরা যেভাবে একের পর এক জামিন পাচ্ছে, তা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। তাদের জামিনে মুক্তি মানে আবারও ভয়, আবারও রক্তপাতের আশঙ্কা।” তাঁর মতে, এই প্রক্রিয়ার পেছনে যারা কাজ করছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনা জরুরি, না হলে ন্যায়বিচারের ওপর আস্থা কমে যাবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র আরও জানায়, জামিনে মুক্ত হওয়ার পর অনেক সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী ও আওয়ামী লীগ নেতা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনে ঢুকে পড়ছে। এমনকি জুলাই যোদ্ধাদের কিছু প্ল্যাটফর্মেও অনুপ্রবেশের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এটি শুধু নিরাপত্তা হুমকি নয়, বরং আন্দোলনের ভেতরে বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাস ছড়ানোর একটি কৌশল বলেও অনেকে মনে করছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের ৫৬ হাজারের বেশি নেতাকর্মী গ্রেফতার হলেও প্রায় ৩৯ হাজারই এখন জামিনে বাইরে। বিভিন্ন জেলা ও মেট্রোপলিটন এলাকায় এই হার ক্রমেই বাড়ছে। পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “গ্রেফতার হওয়া আসামিরা কীভাবে এত দ্রুত জামিনে বেরিয়ে আবার সংগঠিত হচ্ছে, তা আমাদের কাছেও প্রশ্নের বিষয়।” তিনি জানান, রাজনৈতিক চাপ, ভোটের হিসাব, অর্থনৈতিক লেনদেন—সবকিছু মিলিয়ে এমন এক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে যেখানে আইনের শাসন বারবার আপসের মুখে পড়ছে।
একজন অতিরিক্ত আইজি বলেন, “ফ্যাসিবাদের দোসরদের আবার রাজনৈতিক দলে টেনে নেওয়া আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।” তাঁর মতে, জামিনে মুক্ত হয়ে কেউ কেউ নতুন প্ল্যাটফর্মে ঢুকে ভেতর থেকে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের সুযোগ পাচ্ছে, যা সাম্প্রতিক সহিংস হামলাগুলোর মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর এই মন্তব্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরেও এক ধরনের হতাশা ও ক্ষোভের ইঙ্গিত দেয়।
ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী বলেন, পুলিশের দায়িত্ব আসামি গ্রেফতার ও আদালতে জামিনের বিরোধিতা করা। আদালত যদি জামিন দেয়, সেখানে পুলিশের কিছু করার থাকে না। তবে তিনি জানান, জামিনপ্রাপ্তদের অনেককেই নজরদারিতে রাখা হয়েছে এবং তাদের চলাফেরা, যোগাযোগ ও আর্থিক লেনদেন বিশ্লেষণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মেট্রোপলিটন ও রেঞ্জ পর্যায়ে জামিনের হার ৫০ থেকে ৯০ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এই হার উদ্বেগজনক, কারণ এটি কেবল বিচার ব্যবস্থার নমনীয়তা নয়, বরং রাজনৈতিক প্রভাবেরও বহিঃপ্রকাশ।
অতিরিক্ত আইজি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, “জামিনপ্রাপ্ত দোসররা আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে—এমন গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া গেছে। সে অনুযায়ী আমরা সতর্ক অবস্থানে আছি।” তাঁর ভাষায়, “যদি এই প্রবণতা বন্ধ না হয়, তাহলে আবারও সহিংস রাজনীতির ফিরে আসার আশঙ্কা থেকে যাবে।”
ফলত, এই পুরো চিত্র কেবল আইনি বিতর্ক নয়—এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি দেশ তখনই টেকসই শান্তি পায়, যখন ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতা নিরপেক্ষভাবে কাজ করে। কিন্তু যদি অপরাধের দায়ে অভিযুক্তরা অল্প সময়ের মধ্যেই প্রভাব, অর্থ বা তদবিরের মাধ্যমে মুক্তি পায়, তবে জনগণের আস্থা ভেঙে যায়। এই আস্থাহীনতা থেকেই জন্ম নেয় অনিশ্চয়তা, যা শেষ পর্যন্ত পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই নড়বড়ে করে তোলে।
জুলাই আন্দোলনের পর জনগণের প্রত্যাশা ছিল, যারা বছরের পর বছর নিপীড়ন, দুর্নীতি ও দমননীতিতে যুক্ত ছিল, তারা আইনের মুখোমুখি হবে এবং শাস্তি পাবে। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ না হয়ে, যখন দেখা যাচ্ছে তারা আবারও রাজপথে ফিরছে, তখন এক অস্বস্তিকর প্রশ্ন উঠে আসে—বদলে গেছে সরকার, কিন্তু বদলেছে কি রাজনীতির সংস্কৃতি?
আপনার মতামত জানানঃ