
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সময় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ও নাগরিক সমাজের মধ্যে এক ধরনের আশা-প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল যে, দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতি, অর্থ পাচার, স্বজনপ্রীতি ও অস্বচ্ছ শাসনব্যবস্থার পর এবার অন্তত একটি নতুন ধারার সূচনা হবে। শেখ হাসিনার পতনের পর যেভাবে জুলাই মাসে গণঅভ্যুত্থানের ঢেউ দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজ হবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি প্রবর্তন করা। বিশেষ করে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তার উপদেষ্টা পরিষদের সকল সদস্য দ্রুততম সময়ে নিজেদের আয়-সম্পদের হিসাব জনগণের সামনে প্রকাশ করবেন। এমনকি এর জন্য একটি নীতিমালাও প্রণয়ন করা হয়েছিল।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও কোনো উপদেষ্টার সম্পদ ও আয়ের তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। বরং উল্টো তাদের বিরুদ্ধে নানান ধরনের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠে এসেছে। এ অবস্থায় জনমনে হতাশা বাড়ছে এবং অনেকেই মনে করছেন যে, এই সরকারের মধ্যে আরেকটি অস্বচ্ছ শাসনব্যবস্থার বীজ বপন হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি’র সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, হাসিনা সরকার যেমন নির্বাচনী ইশতেহারে স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি দিয়েও শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করেনি, ইউনূস সরকারও একই পথে হাঁটছে। অথচ তাদের হাতে ছিল দৃষ্টান্ত স্থাপনের একটি বিরল সুযোগ। যদি তারা সত্যিই সম্পদ-আয়ের হিসাব প্রকাশ করতো, তাহলে ভবিষ্যৎ সরকারগুলোর জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির একটি নজির তৈরি হতো। কিন্তু তা হয়নি।
টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানও বলছেন, তথ্য প্রকাশ না করার মানে হলো জনগণের চোখে সন্দেহ তৈরি হওয়া। যদি কিছুই গোপন করার না থাকে তবে কেন এই তথ্য প্রকাশ করা হলো না? এ প্রশ্ন থেকেই যায়। তার মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের এই ব্যর্থতা ভবিষ্যৎ সরকারগুলোকেও দায় এড়ানোর সুযোগ করে দেবে। তারা তখন বলতে পারবে, অন্তর্বর্তী সরকারও পারেনি, তাহলে আমাদের কেন চাপ দেওয়া হচ্ছে?
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ আরও কঠোরভাবে বিষয়টি দেখছেন। তার মতে, ইউনূস সরকার ক্ষমতায় এসেও পুরনো স্বজনপ্রীতি ও সুবিধা বণ্টনের পথেই হাঁটছে। বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সরকারের বিশেষ সুবিধা প্রদান—যেমন ২০২৯ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি, শেয়ার কমিয়ে দেওয়া, নতুন লাইসেন্স অনুমোদন ইত্যাদি—এক ধরনের স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে। যেভাবে আগের সরকারের সময় আত্মীয়-স্বজন বা ঘনিষ্ঠদের জন্য সুযোগ তৈরি করা হতো, এখানেও একই ধারা দেখা যাচ্ছে।
এছাড়া উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে। সাবেক সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তার সরাসরি বলেছেন যে, অন্তত আটজন উপদেষ্টা সীমাহীন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। যদিও সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং প্রমাণ চাইছে, তবে সমালোচকদের মতে সরকারের উচিত ছিল নিজেরাই স্বপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত শুরু করা। বাস্তবে তা হয়নি।
এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। যে জনগণ এক বছর আগে পরিবর্তনের আশায় উল্লাস করেছিল, তাদের অনেকেই এখন আবার হতাশ হয়ে পড়ছেন। এর ফলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও আগত নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
অধ্যাপক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার কোনো রাজনৈতিক দলের ভিত্তিতে নয়, নৈতিক ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে। তাই তাদের জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মানদণ্ড রক্ষা করা ছিল অপরিহার্য। কিন্তু তারা যদি সেই জায়গায় ব্যর্থ হয়, তবে শুধু নিজেদের জন্য নয়, বরং পুরো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার জন্যই এটি এক ধরনের দুর্বলতা তৈরি করবে।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, সরকারের মধ্যে “অস্বীকারের সংস্কৃতি” চলছে। আগের সরকারের মতোই তারা সমালোচনা বা প্রশ্ন তোলা সহ্য করতে পারছে না। অথচ পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েই তারা ক্ষমতায় এসেছে। এখন যদি একই ধারা চলতে থাকে, তাহলে জনগণের আস্থা আরও দ্রুত হারিয়ে যাবে।
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, অন্তর্বর্তী সরকার তার মূল প্রতিশ্রুতি—স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি—বাস্তবায়নে ব্যর্থ হচ্ছে। এতে শুধু সরকারের ভাবমূর্তিই নয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, সুশাসন ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎও প্রশ্নের মুখে পড়ছে। জনগণের কাছে এর বার্তা স্পষ্ট—শুধু মুখের প্রতিশ্রুতি নয়, বাস্তব পদক্ষেপই পরিবর্তনের প্রকৃত চিহ্ন বহন করে। আর সেই পরীক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকার অন্তত এখন পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে।
আপনার মতামত জানানঃ