বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন রুটে নতুন ট্রেন চালুর পেছনে রাজনৈতিক নেতাদের ইচ্ছা ও চাপ বড় ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের দাবির প্রেক্ষিতে বহু ট্রেন চালু করা হয়, গন্তব্য পরিবর্তন হয়, এমনকি নতুন স্টেশনে ট্রেন থামানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যার অনেকগুলোই ছিল আর্থিকভাবে অকার্যকর। এভাবে রাজনৈতিক আবদারে পরিচালিত এই সিদ্ধান্তগুলো এখন রেলওয়ের ওপর চরম আর্থিক চাপ সৃষ্টি করেছে।
২০১৪ সালে চালু হওয়া বিজয় এক্সপ্রেস প্রথমে ময়মনসিংহ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত চললেও ২০২৩ সালে জামালপুরে স্থানান্তরিত করা হয়। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কোনো গবেষণা বা সমীক্ষা করা হয়নি। রুট পরিবর্তনের ফলে যাত্রীর সংখ্যা কমে যায়, আর বর্তমানে ট্রেনটির আয়ে খরচই উঠে আসে না।
এমনকি রেলওয়ের নিজের হিসাব বলছে, শতভাগ যাত্রী পেলেও আন্তনগর ট্রেনে লাভ করা কঠিন। এর কারণ হলো জ্বালানি, লোকবল, রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন খরচ। তাছাড়া ইঞ্জিন ও কোচের সংকট তো আছেই। তাই এখন রেল কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে কম যাত্রীপ্রবাহের ট্রেন বন্ধ করে জনপ্রিয় ও লাভজনক রুটে ট্রেন সংখ্যা বাড়াতে।
২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ৬৬টি আন্তনগর এবং ৯২টি অন্যান্য ধরনের ট্রেন চালু করলেও একই সময়ে জনপ্রিয় ৯৮টি মেইল, লোকাল ও কমিউটার ট্রেন বন্ধ করে দেয়। এর মাধ্যমে রেলের ব্যয় বেড়ে গেলেও রাজস্ব আয় বাড়েনি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস চালুর পেছনে প্রয়াত মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের চাহিদা ছিল। মাত্র ৬ কিমি দূরত্বের স্টেশন তৈরি হলেও ট্রেনটি রাতে রাখার জন্য উপযুক্ত জায়গা না থাকায় এটি ঈশ্বরদী গিয়ে ঘুরে আসে—ফলে সময় ও খরচ দুই-ই বাড়ে। আবার ঢালারচর এক্সপ্রেস চালু হয় বিশাল ব্যয়ে নির্মিত রেলপথে, অথচ যাত্রীসংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, এবং আয়ের অঙ্ক প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম।
উপকূল এক্সপ্রেস, একসময় জনপ্রিয় ট্রেন হলেও, বর্তমানে তার আসন পূর্ণ হয় না। কারণ, এখন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হয়েছে এবং উন্নতমানের বাস নামায় যাত্রীরা ট্রেনের চেয়ে বাসকেই পছন্দ করছেন। অথচ এই অবস্থার মধ্যেও ২০২৩ সালে ‘সুবর্ণচর এক্সপ্রেস’ চালুর পরিকল্পনা নেয়া হয়, যার নাম ঠিক করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু পর্যাপ্ত কোচ না থাকায় তা চালু হয়নি।
অন্যদিকে উত্তরের রুটে যাত্রীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি হলেও সেখানে মনোযোগ কম। কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস ও লালমনিরহাট এক্সপ্রেস মাসে দুই কোটি টাকার মতো আয় করে, একতা এক্সপ্রেস মাসে চার কোটিরও বেশি আয়ে আসে। তবে বিকল্প রেক না থাকায় ট্রেনগুলো দেরি করেই চলে। সময়মতো যাত্রা নিশ্চিত না হওয়ায় যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েন।
এই অবস্থার পরিবর্তনে অন্তর্বর্তী সরকার রেলওয়ে রুট রেশনালাইজেশনের উদ্যোগ নিয়েছে। কম যাত্রীসংখ্যার ট্রেন বন্ধ করে বেশি চাহিদার রুটে ট্রেন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে, যেটির নেতৃত্বে আছেন রেল মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রূপম আনোয়ার। তবে ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও কমিটি এখনো সুপারিশ চূড়ান্ত করতে পারেনি।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে অলাভজনক ট্রেন ধাপে ধাপে বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং লাভজনক রুটে নতুন ট্রেন দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক কারণে চালু করা অনেক ট্রেন পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরিবহন বিশেষজ্ঞ সামছুল হক এই অপেশাদারি সিদ্ধান্তগুলোর সমালোচনা করে বলেন, রেল একটি আয়করী প্রতিষ্ঠান নয়—এমন কথা বলার মাধ্যমে মন্ত্রীরা প্রকল্পের ব্যর্থতাকে আড়াল করেন। অথচ সময়োপযোগী সমীক্ষা করলেই বোঝা যেত কোন রুটে ট্রেন চালু করা উচিত, আর কোথায় তা বন্ধ করাই ভালো।
এই বিশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার কারণে বর্তমানে রেলওয়ের বার্ষিক লোকসান দাঁড়িয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি, যা ২০০৯-১০ অর্থবছরের ৬৯০ কোটি টাকা থেকে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে অপচয় আর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না থামালে ভবিষ্যতে রেলওয়ের আর্থিক সঙ্কট আরও ভয়াবহ আকার নিতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ