ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক সমালোচনার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে গাজায় ভয়াবহ মানবিক সংকট। প্রতিদিন বোমাবর্ষণ ও হামলার ফলে হাজারো মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, ঘরবাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র দেখা যাচ্ছে দুর্ভিক্ষ ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার—শিশুরা অনাহারে কঙ্কালসার হয়ে পড়ছে, সাহায্যকেন্দ্রে ভিড় জমাচ্ছে অসহায় মানুষ, আবার অনেকে খাদ্যের সন্ধানে গিয়ে প্রাণ দিচ্ছে। এই দৃশ্যগুলো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় ইসরায়েলের মিত্র দেশগুলোর পক্ষে চুপ থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের প্রতিটি পদক্ষেপকে সমর্থন করে আসা আমেরিকান ও ব্রিটিশ ইহুদি সংগঠনগুলোও এখন দ্বিধায় পড়েছে। আগে তারা যুক্তি দিত যে ইসরায়েল “ন্যায্য যুদ্ধ” করছে, কিন্তু এখন তারা প্রকাশ্যে বলছে যে বেসামরিক মানুষের অনাহার, শিশুদের মৃত্যু ও দুর্ভোগ কোনোভাবেই ন্যায়সংগত নয়। আমেরিকান জিউইশ কমিটি, র্যাব্বিনিকাল অ্যাসেম্বলি এবং রিফর্ম জুডাইজমের মতো সংগঠন প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ইসরায়েল যদি এভাবে সাহায্য আটকে রাখে ও অনাহারকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, তবে তা ইহুদি ধর্মের নৈতিক মূল্যবোধকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে। কয়েক হাজার রাব্বি যৌথভাবে একটি চিঠিতে ঘোষণা করেছেন যে তারা গণহত্যা বা অনাহারকে সমর্থন করতে পারেন না।
পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনৈতিক অঙ্গনেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বড় ইহুদি সংগঠন বোর্ড অব ডেপুটিজ পর্যন্ত সাহায্য দ্রুত বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। জার্মানি, যারা এত দিন ইসরায়েলের অস্ত্র সরবরাহ করত, তারাও অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করেছে। ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ডসহ একাধিক দেশ এখন প্রকাশ্যে ইসরায়েলের পুনর্দখল পরিকল্পনার বিরোধিতা করছে। এমনকি পশ্চিমাদের ভেতরে আলোচনা শুরু হয়েছে জাতিসংঘে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে, যাতে তারা নিজেদের দায় কিছুটা লঘু করতে পারে।
মানবাধিকার সংগঠন বেতসেলেম ও ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস ইসরায়েল প্রকাশ্যে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা আখ্যা দিয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক চাপ আরও বেড়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পর্যন্ত নেতানিয়াহুকে সতর্ক করে বলেছেন দুর্ভিক্ষের বাস্তবতা অস্বীকার করা বন্ধ করতে। যদিও ইসরায়েলের ভেতরে অধিকাংশ জনগণ এই দুর্ভিক্ষে বিশেষ বিচলিত নয়, কিন্তু আন্তর্জাতিক জনমত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তীব্র হয়ে উঠছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলের এই পরিস্থিতি অনেকটা আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধের সময় ফ্রান্সের অবস্থানের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। তখন যেমন ফরাসি জনগণ উপনিবেশ রক্ষার নামে চালানো সহিংসতায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, এখন তেমনি পশ্চিমা জনমত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। জরিপগুলো বলছে, পশ্চিমা বিশ্বের ডান-বাম উভয় পক্ষের জনগণই ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে নিন্দা করছে। যুক্তরাষ্ট্রে শুধু উদারপন্থীরা নয়, ট্রাম্পপন্থী রক্ষণশীলরাও ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন সমর্থনের বিরোধিতা করছে।
সব মিলিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া এই প্রবল সমালোচনা ও মিত্রদের ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া দেশটির ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে। নেতানিয়াহু নিজেই এক দশক আগে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে ইসরায়েল হয়তো শততম জন্মদিন পর্যন্ত টিকে থাকতে নাও পারে। আজকের পরিস্থিতি সেই আশঙ্কাকেই আরও বাস্তব করে তুলছে।
আপনার মতামত জানানঃ