গাজায় ত্রাণ বিতরণের “নিরাপত্তা” আজ যে রাজনৈতিক প্রতীকে ভরা, তার সাম্প্রতিকতম প্রমাণ হলো মার্কিন বাইকার গ্যাং ‘ইনফিডেলস এমসি’-র সদস্যদের একটি বেসরকারি ঠিকাদারি সংস্থার মাধ্যমে নিযুক্ত করা—আর সেই দলটির সদস্যরা বহু বছর ধরে প্রকাশ্যে ইসলামবিদ্বেষী ভাষ্য ও ক্রুসেড-প্রতীক ব্যবহার করে এসেছে। এই চিত্রটি কেবল একটি নৈতিক ব্যত্যয় নয়; এটি সাহায্যকেন্দ্রগুলোর সামনে প্রতিদিন যে অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক ও রক্তক্ষয়, সেটিকেও তীব্র করে তোলে। ব্রিটেনে বহু মাধ্যমে প্রতিধ্বনিত বিবিসির অনুসন্ধান দেখিয়েছে—গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) যে বিতরণ কেন্দ্রগুলো চালাচ্ছে, সেখানকার সশস্ত্র নিরাপত্তায় কাজ করছে ‘ইউজি সলিউশনস’ (UG Solutions) নামের কন্ট্রাক্টরের অধীনে থাকা অন্তত দশ জন ইনফিডেলস সদস্য; নেতৃত্বেও রয়েছেন তাদের কয়েকজন শীর্ষ ব্যক্তি।
ইনফিডেলস এমসি-র আত্মচিত্র নিজেই একটি বার্তা: নিজেদের ‘ক্রুসেডার’ বা ধর্মযোদ্ধা ভাবা, ১০৯৫ সাল (প্রথম ক্রুসেডের সূচনা) ট্যাটু করা, ‘ক্রুসেডার ক্রস’কে চিহ্ন বানানো—এসব প্রতীকের মাধ্যমে তারা ইসলামকে শত্রু হিসেবে কল্পনা করে। সামাজিক মাধ্যমে রোজকার ট্রলিং ছাড়াও মুসলিমবিদ্বেষী পোস্ট, রমজানকে বিদ্রূপ করে ‘পিগ রোস্ট’ ইভেন্টের প্রচার—এই সবকিছু একত্রে এমন একটি সংস্কৃতি তৈরি করে যেখানে ‘মানবিক সাহায্য নিরাপত্তা’ মানেই ক্ষমতার একরোখা প্রদর্শনী। গাজায় একই প্রতীকের ছাপ দেখা যাচ্ছে: কন্ট্রাক্টরদের কেউ কেউ “মেক গাজা গ্রেট এগেইন” ব্যানার তুলেছেন; কারও আঙুলে ‘Crusader’ ট্যাটু, নতুন টি-শার্টে “Embrace Violence” টাইপ স্লোগান। এতে যে বার্তা যায়—‘আমরা কেয়ার করি না, কেবল নিয়ন্ত্রণ চাই’—তা গাজাবাসীর বিশ্বাসে গভীর ক্ষত তৈরি করে।
বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা ইউজি সলিউশনস বলছে, নিয়োগের আগে তারা ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে এবং “ব্যক্তিগত হবি বা কর্মক্ষেত্র-বহির্ভূত সংযোগ” দেখে কাউকে বাতিল করে না। কাগজে কলমে এ যুক্তি নিরপেক্ষ মনে হলেও বাস্তবে নিরাপত্তা ও মানবিকতার ভারসাম্য ভেঙে পড়ে—কারণ নিরাপত্তাকর্মীর প্রতীক, ভাষ্য ও অতীত আচরণ মাঠপর্যায়ে ‘পাওয়ার রিলেশন’ নির্ধারণ করে। কারও গায়ে ‘১০৯৫’ বা ক্রুসেডার ক্রস থাকলে ক্ষুধার্ত, আহত বা বাস্তুচ্যুত মানুষটি তার হাতে খাবারের কার্ড তুলতে কতখানি স্বচ্ছন্দ বোধ করবে? মানবিক কার্যক্রমে ‘দেখতে কেমন’—এটি কেবল ধোপদুরস্ত ইমেজ নয়; এটি আস্থার পাথেয়। তা ছাড়া, নেতৃত্বে থাকা জনি “ট্যাজ” মালফোর্ডের বিরুদ্ধে অতীতে ঘুষ, চুরি ও মিথ্যা বিবৃতির অভিযোগে শাস্তিপ্রাপ্তির তথ্য এই আস্থার সংকটকে আরও বাড়ায়।
গাজায় জিএইচএফের সাইটগুলোর সামনে গত কয়েক মাসে যা ঘটেছে—তা আস্থাহীনতার পথে কীভাবে হিংসা জন্মায় তার উদাহরণ। জাতিসংঘের হিসেবে সাহায্যের লাইনে অথবা তার আশপাশে শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটেছে; বিভিন্ন প্রতিবেদনে এই সংখ্যায় তারতম্য আছে—কোথাও বলা হয়েছে ৮৫৯ জন, আবার কোথাও ১,১০০–এর বেশি। ইসরায়েলি বাহিনী এই ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করছে বলে জানিয়েছে, আর ইউজি সলিউশনস স্বীকার করেছে কখনো সখনো ‘ওয়ার্নিং শট’ ছোঁড়া হয়েছে; তবে বেসামরিকদের ওপর লক্ষ্য করে গুলি চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে। সংখ্যার এ অসামঞ্জস্য নিজেই দেখায়—যা ঘটছে তা খুবই তরল, কিন্তু নিশ্চিত হলো: খাদ্যের সন্ধানে আসা মানুষ প্রাণ দিচ্ছে, এবং সেই দৃশ্যকে “নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা” নাম দিয়ে স্বাভাবিক করা হচ্ছে।
এখানেই বড় প্রশ্ন: মানবিক সহায়তার নীতি কি নিরাপত্তার নামে মিলিটারাইজেশনকে অনুমোদন দেয়? ‘হিউম্যানিটারিয়ান নিউট্রালিটি’ বা নিরপেক্ষতার একটি মৌল নীতি হলো—সাহায্যের কাজে প্রতীকী-রাজনীতি ঢোকানো যাবে না, যাতে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর যে কোনো অংশ নিজেকে লক্ষ্যবস্তু মনে না করে। এখানে প্রতীকী-রাজনীতি শুধু ঢুকেছে তা নয়, সেটি নীতিবাক্য হয়ে উঠেছে। যখন নিরাপত্তা প্রদানকারী দলের পরিচয়ই হলো ‘ইনফিডেলস’—অর্থাৎ আরবিতে ‘কাফের’—তখন এটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি ভূখণ্ডে সরাসরি ধর্মীয় অবমাননার সংকেত পাঠায়। ফলে যে ‘ইন্টারন্যাশনালাইজড’ ত্রাণ-পরিকাঠামো গড়ে উঠেছে, সেটি স্থানীয় সমাজের চোখে আরও বেশি করে অনুপ্রবেশকারী শক্তি বলে ধরা পড়ছে। এই বোধ থেকেই লাইনে দাঁড়ানো মানুষেরা নিরাপত্তাকে ‘শত্রু’ হিসেবে কল্পনা করতে শুরু করে—আর শত্রুবোধ বাড়লে বিশৃঙ্খলা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, গুলি, মৃত্যু—সবই বাড়ে।
কেবল মাঠে দাঁড়ানো কন্ট্রাক্টরদের প্রতীক বা ভাষ্য নয়, নিয়োগপ্রক্রিয়াও প্রশ্নের মুখে। অনুসন্ধানে এসেছে—ইউজি সলিউশনস প্রায় ৩২০ জনকে নিয়োগ দিয়েছে, তাদের মধ্যে চল্লিশ জনের মতো ইনফিডেলস এমসি থেকে; শীর্ষ পদেও আছেন কয়েকজন। বেতন কাঠামোতে দৈনিক ৯৮০ ডলার থেকে টিম লিডার হলে ১,৫৮০ ডলার পর্যন্ত—এই ‘মোটা মাইনে’র চাকরি ঠিক কীভাবে, কার মাধ্যমে, কোন মানদণ্ডে বরাদ্দ হলো—এখানেও স্বচ্ছতার ঘাটতি। সামাজিক মাধ্যমে মালফোর্ডের পোস্টে দেখা গেছে—“যারা এখনও গুলি চালাতে সক্ষম”—এমন অভিজ্ঞতা খোঁজা হয়েছে। খাদ্য-নিরাপত্তার সংকটে থাকা একটি যুদ্ধক্ষেত্রে ‘শুট-অ্যান্ড-মুভ’ দক্ষতা প্রয়োজন হতে পারে; কিন্তু এই দক্ষতা যদি এমন গোষ্ঠী থেকে আসে যারা প্রকাশ্যে ইসলামবিদ্বেষী, তাহলে মানবিকতার সীমানা ভেঙে পড়ে।
এই ব্যাকড্রপে সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলো ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম সিভিল রাইটস সংগঠন ‘সিএআইআর’ বলেছে—ইনফিডেলসকে গাজায় ত্রাণে লাগানো মানে সুদানে কু ক্লাক্স ক্ল্যানকে দিয়ে ত্রাণ বিলি করানো; তারা জিএইচএফকে গাজা থেকে সরিয়ে দিতে বলেছে। এমন তুলনা শুধু আবেগের নয়—এটি নীতি-গত যুক্তি: যে কোনো ঘৃণাবাদী সংগঠনের সদস্যদের দিয়ে ‘মানবিক নিরপেক্ষতা’ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বাস্তবে যা ঘটেছে—হিংসা, অব্যবস্থা, আতঙ্ক—তা সেই যুক্তিকেই সত্যি প্রমাণ করে।
এখন প্রশ্ন—জিএইচএফের ভূমিকাই বা কী? গঠনের শুরু থেকে তাদের লক্ষ্য ছিল জাতিসংঘ-নির্ভর চেইন এড়িয়ে ‘সরাসরি ও দ্রুত’ সহায়তা বিতরণ করা। মার্কিন ও ইসরায়েলি সমর্থনের রাজনৈতিক ও আর্থিক খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে তারা মে মাসে কার্যক্রম শুরু করে—কিন্তু মাঠে যেতে না যেতেই এই মডেল ঘনঘন মৃত্যুর পরিসংখ্যান, বিতর্কিত নিরাপত্তা, এবং ‘দলবদল করা কন্ট্রাক্টর-কালচার’—সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। ত্রাণ বিতরণকে যদি মানবিক আস্থার ওপর দাঁড় করাতে হয়, তবে স্থানীয় সমাজ, পরিচয়, ধর্মীয় সংবেদন—সব মেপে চলতে হয়; এই জায়গাটিতেই জিএইচএফের ‘বাইপাস’ কৌশল ধাক্কা খেয়েছে। কারণ আস্থা বাইপাস করা যায় না—তা কেবল অর্জন করা যায়।
অবশ্য, ঘটনাটিকে শুধু ‘একটি খারাপ নিয়োগ’ হিসেবে দেখলে চলবে না। এখানে রয়েছে ‘হাইব্রিড যুদ্ধ-অর্থনীতি’র এক ঝলক, যেখানে নিরাপত্তা, লজিস্টিকস, ত্রাণ, তথ্যপ্রচার—সবকিছুর যোগান দেয় বাজার-চালিত কন্ট্রাক্টিং শিল্প। যুদ্ধ যত লম্বা হয়, তত বাড়ে এই শিল্পের প্রভাব; আর প্রভাব যত বাড়ে, ততই বেড়ে যায় জবাবদিহির ফাঁক। যে কোম্পানি আপনাকে খাবারের লাইনে দাঁড় করায়, সেই কোম্পানিই যখন আপনার সামনে অস্ত্র তাক করে ‘ভিড় নিয়ন্ত্রণ’ করবে—তখন সেখানেই সাহায্য ও নিয়ন্ত্রণের সীমারেখা অস্পষ্ট হয়ে যায়। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, নিরাপত্তা-সংক্রান্ত কনটেন্ট ও মেরচেন্ডাইজ বিক্রির মাধ্যমে ‘যুদ্ধ-দৃশ্যকে’ ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছে—যেন গাজা কেবল সহিংসতার থিম পার্ক।
এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন (আইএইচএল)-এর আলোচনাও জরুরি। ভিড় নিয়ন্ত্রণে ‘ওয়ার্নিং শট’ ছোঁড়া হলেও, সেটি যদি বারবার হতাহতের প্রেক্ষাপট তৈরি করে, তবে সেটি অনুপাত, প্রয়োজনীয়তা ও পার্থক্যর (proportionality, necessity, distinction) নীতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। আরও বড় কথা, যে বাহিনী বা কন্ট্রাক্টর কাজ করছে তার ‘বায়াস’ যদি চোখে পড়ার মতো স্পষ্ট হয়—ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বিদ্বেষ যদি তাদের ব্র্যান্ডের অংশ হয়ে যায়—তাহলে ‘ডিউটি অব কেয়ার’ বা যত্নের দায়িত্ব পালনে ব্যত্যয় ঘটে। ফলে প্রতিটি নতুন মৃত্যুর সঙ্গে মানবিক ব্যবস্থার নৈতিক বৈধতা কমতে থাকে।
একই সঙ্গে একটি নীতি-প্রস্তাব সামনে আসে: সাহায্য ও নিরাপত্তা পৃথক রাখতে হবে; নিরাপত্তাকর্মীর প্রতীকে ঘৃণার ইশারা চলবে না; কন্ট্রাক্টরের সামাজিক-মিডিয়া আচরণও হবে অডিটের অংশ; মাঠে কাজ করা দলের সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় সেন্সিটিভিটি হবে প্রশিক্ষণের বাধ্যতামূলক ধাপ। কেবল অস্ত্রধারণের দক্ষতা নয়—‘আস্থা গড়ার’ দক্ষতাই মানবিক নিরাপত্তার মূল। স্থানীয় সমাজের প্রতিনিধি, নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক সংস্থা ও স্বীকৃত এনজিও—এই ত্রিপাক্ষিক অংশীদারিত্বের বাইরে ‘বাইপাস’ যত বাড়বে, তত বাড়বে মৃত্যুঝুঁকি।
পরিশেষে, এই কাহিনি আমলাতান্ত্রিক ব্যর্থতা বা কারিগরি ‘সাইট ম্যানেজমেন্ট’ সমস্যার গল্প নয়; এটি মূল্যবোধের গল্প। যে জায়গায় রুটি ও চালের প্যাকেট মানুষের প্রাণের সমার্থক, সেখানে নিরাপত্তার ধারণা যদি ঘৃণার প্রতীকে চিহ্নিত হয়, তাহলে সাহায্যও হয়ে ওঠে আরেকটি যন্ত্রণা। গাজার মানুষ আজ খাদ্যের পাশাপাশি মরিয়া হয়ে খুঁজছে ‘সম্মানিত হওয়া’র অনুভবটি—যা না থাকলে সাহায্য কেবল সংকটকে লম্বা করে। ইনফিডেলস এমসি-কে সশস্ত্র নিরাপত্তায় বসানো সেই সম্মানের বোধের বিপরীতমুখী—তার প্রতিটি ট্যাটু, প্রতিটি স্লোগান, প্রতিটি পোস্টার যেন বলে: ‘তুমি আমাদের নয়, আমরা তোমার ওপরে।’ এই দূরত্ব কমানোই এখন মানবিকতার প্রথম কাজ। আর সেটি শুরু হবে এমন প্রতীকের অবসান দিয়ে, যা সাহায্যকে যুদ্ধের শাখা হিসেবে দেখায়।
এই সংকটকে ঘিরে সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধান, সিএইআরের প্রতিবাদ, বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে প্রতিধ্বনি—সব মিলিয়ে একটি আন্তর্জাতিক জবাবদিহির ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। জিএইচএফের পক্ষে এখন সেরা কাজ হবে—নিয়োগে সম্পূর্ণ পুনর্মূল্যায়ন, মাঠে স্বনির্মিত প্রতীক-রাজনীতির অবসান, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ অংশীদারদের আহ্বান, এবং নিহত-আহতদের ঘটনাগুলোয় স্বচ্ছ তদন্তে সহযোগিতা। মানবিক কাজের শক্তি হলো—মানুষের কাছে নিজেকে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ করে তোলা। বিশ্বাস একবার হারালে খাবার-ট্রাক বাড়িয়ে লাভ নেই; আগে ফিরিয়ে আনতে হবে আস্থা।
আপনার মতামত জানানঃ