ভারত একসময় ফিলিস্তিনের সবচেয়ে বড় বন্ধু ছিল। ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে নেহরু ও গান্ধী পর্যন্ত—সবাই ফিলিস্তিনিদের অধিকারকে সমর্থন করেছেন। মোহনদাস গান্ধী বলেছিলেন, ইহুদিরা অবশ্যই নিরাপত্তা পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে ইসরায়েল তৈরি করা অন্যায়ের সমান। ভারতের স্বাধীনতার পর থেকেই ফিলিস্তিনকে নানা ভাবে সাহায্য করেছে দিল্লি। আর্থিক সহায়তা, শিক্ষাবৃত্তি, ত্রাণ পাঠানো—সবই চলত নিয়মিতভাবে।
ইন্দিরা গান্ধী ও প্যালেস্টাইনের নেতা ইয়াসের আরাফাতের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আরাফাত ইন্দিরাকে “আমার বড় বোন” বলে ডাকতেন। দুজনের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক ছিল গভীর। ভারতের জনগণও তখন ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। ভারতের নীতিতে তখন এক ধরনের মানবিকতা ছিল—যেখানে উপনিবেশবাদ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়া হতো। স্বাধীনতার প্রথম কয়েক দশক জুড়ে ভারত বিশ্বের নির্যাতিত জাতিগোষ্ঠীর পাশে ছিল, আর সেই ধারায় ফিলিস্তিনও ভারতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিল।
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে ফিলিস্তিন বিভাজনের পরিকল্পনার সময় ভারত তার বিরোধিতা করেছিল। এমনকি ইসরায়েলকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দেওয়ার বিরুদ্ধেও ভোট দেয়। ভারতের নীতিগত অবস্থান তখন স্পষ্ট ছিল—উপনিবেশবাদের বিরোধিতা এবং ন্যায়বিচারের পক্ষে থাকা। ১৯৭৪ সালে ভারত ছিল বিশ্বের প্রথম নন-আরব দেশ, যারা প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও-কে ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৮৮ সালে ভারত ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়। তখন ভারতের পররাষ্ট্রনীতির একটি মূল স্তম্ভই ছিল ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের নীতি পাল্টে যেতে থাকে। ১৯৯০-এর দশকে যখন বিশ্ব রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন শুরু হয়, তখন ভারতও নতুন অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক দিশা নিতে শুরু করে। ১৯৯২ সালে প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমহা রাওয়ের আমলে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলকে কূটনৈতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। এর পেছনে বড় ভূমিকা ছিল রাজীব গান্ধীর আমলের একটি সিদ্ধান্তে। ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের এক বৈঠকে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী শিমন পেরেজের সাক্ষাৎ হয়। পেরেজ তখন রাজীবকে বোঝান, ইসরায়েলও পশ্চিম এশিয়ায় গণতন্ত্রের প্রতীক, যেমন ভারত দক্ষিণ এশিয়ায়। সেই ভাবধারার প্রভাবেই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ধারণা জন্ম নেয়।
১৯৯২ সালে ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসের আরাফাতকে পাশে বসিয়ে ভারত যখন ইসরায়েলের সঙ্গে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে, তখন অনেকেই হতবাক হয়ে যান। কিন্তু আরাফাত তখন প্রকাশ্যে কোনো আপত্তি জানাননি। কারণ, তখন ইসরায়েল ও পিএলও-র মধ্যে গোপন আলোচনার মাধ্যমে ‘অসলো চুক্তি’ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। আরাফাত হয়তো ভেবেছিলেন, ভারতের এই পদক্ষেপে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র গঠনের পথ সহজ হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি—বরং ভারত ধীরে ধীরে ফিলিস্তিন থেকে দূরে সরে যায়।
১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধের পর ভারত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানির জন্য ইসরায়েলের উপর নির্ভর করতে শুরু করে। তখন থেকেই দুই দেশের সম্পর্ক গভীর হতে থাকে। আজ ইসরায়েল ভারতের অন্যতম প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। প্রতিরক্ষা, কৃষি, প্রযুক্তি, সাইবার নিরাপত্তা—সবক্ষেত্রেই ভারতের অংশীদার হয়ে উঠেছে ইসরায়েল। এই পরিবর্তনের ফলে ভারতের পুরনো নৈতিক অবস্থান, যা মানবিকতা ও ন্যায়বিচারের উপর ভিত্তি করেছিল, সেটি দুর্বল হয়ে যায়।
বিশেষ করে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর এই সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়। মোদী ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর মধ্যে বন্ধুত্বের প্রকাশ ঘটে প্রকাশ্যে। মোদী এমনকি ইসরায়েল সফরে যাওয়া প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। সেখানে দুই দেশের সম্পর্ককে “প্রাকৃতিক মিত্রতা” হিসেবে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু সমালোচকদের মতে, এই বন্ধুত্ব ভারতের নৈতিকতার কম্পাসকে সরে দিয়েছে। একসময় যে ভারত নিপীড়িতদের পাশে থাকত, সেই ভারত এখন শক্তির রাজনীতির পাশে দাঁড়িয়েছে।
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোয়া হাসান বলেছেন, ভারতের এই পরিবর্তন শুধু নীতিগত নয়, বরং নৈতিক দিক থেকেও বড় এক পতন। আগে ভারত মানবিকতার ভিত্তিতে অবস্থান নিত, এখন সেখানে এসেছে হিসাব-নিকাশের রাজনীতি। তিনি বলেন, এখন ভারতের অবস্থান হলো “সুচিন্তিত অস্পষ্টতা”—যেখানে ন্যায়বোধের চেয়ে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বড় হয়ে উঠেছে।
গাজার চলমান যুদ্ধেও ভারতের এই অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটলেও ভারত প্রকাশ্যে ইসরায়েলের সমালোচনা করেনি। এমনকি জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবেও ভারত ভোটদানে বিরত থেকেছে। ভারতের যুক্তি ছিল, প্রস্তাবে হামাসের আক্রমণের উল্লেখ নেই। কিন্তু মানবিক দিক থেকে এই নীরবতা অনেককেই বিস্মিত করেছে।
লেখক অরুন্ধতী রায় বলেছেন, একসময় ভারতের সাধারণ মানুষ ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামকে ভালোবাসতেন। এখন সেই সহানুভূতি হারিয়ে গেছে। তিনি বলেছেন, “আগে হয়তো মানুষ ফিলিস্তিনের পক্ষে ছিল, কিন্তু এখন তারা আর তেমন নেই।” তাঁর মতে, ভারতের সমাজে এখন এমন এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে যেখানে ইসরায়েলের সমালোচনা করলে সাধারণ মানুষই প্রতিবাদ দমন করে দেয়।
ধর্মের বিষয়টিও এই পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। অরুন্ধতী রায় মনে করেন, ভারতের হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ ও ইসরায়েলের ইহুদীবাদী জায়নিজমের মধ্যে মতাদর্শগত মিল আছে। এই মিলই দুই দেশকে কাছে এনেছে। ফিলিস্তিন মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ায় ভারতের একাংশের মধ্যে সহানুভূতি কমেছে। আগে যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতের নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এখন সেখানে এসেছে ধর্মভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি।
আজকের ভারতে ইসরায়েলকে সমর্থন করা একধরনের “দেশপ্রেমের” প্রতীক হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ভারতের এক তৃতীয়াংশ মানুষ প্রকাশ্যে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের পক্ষে মত দিচ্ছেন। মাঠে, সোশ্যাল মিডিয়ায় এমনকি খেলাধুলার মঞ্চেও ইসরায়েলের পক্ষে স্লোগান শোনা যায়।
একসময় যেখান থেকে মানবিকতার বার্তা ছড়াত, সেই ভারত এখন বাস্তববাদী ও স্বার্থকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতির অনুসারী। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা জোট ও কৌশলগত স্বার্থ এখন ভারতের মূল বিবেচ্য বিষয়। কিন্তু এই পরিবর্তনে যে মানবিক মূল্যবোধের ক্ষতি হয়েছে, তা অস্বীকার করা যায় না।
ফিলিস্তিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আজ শুধু ইতিহাসের পাতায় সীমিত। একসময় যাদের পাশে থেকে ভারত বিশ্বকে দেখিয়েছিল ন্যায়বোধ ও মানবতার দৃষ্টান্ত, সেই ফিলিস্তিন এখন ভারতের কাছে এক প্রান্তিক বিষয়। ভারত এখন আর ফিলিস্তিনের বন্ধু নয়, বরং ইসরায়েলের কৌশলগত অংশীদার। এই পরিবর্তন শুধু কূটনীতির গল্প নয়, এটি ভারতের আত্মপরিচয়ের এক গভীর পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি।
এক সময়ের মানবিক ভারতের জায়গায় এখন বাস্তববাদী ভারত—যেখানে ন্যায়ের চেয়ে লাভের হিসাব বড়। এই পরিবর্তন ইতিহাসের ধারায় হয়তো অনিবার্য ছিল, কিন্তু তবুও প্রশ্ন থেকে যায়—যে ভারত একদিন নিপীড়িতের পাশে দাঁড়াত, সে কি এখন নিপীড়কের সঙ্গী হয়ে উঠছে না?
আপনার মতামত জানানঃ