নিখোঁজের দুই বছর পর সন্তানের সন্ধান পেয়ে থানায় ছুটে গেলেন হতভাগা বাবা। থানার হাজতে রড ধরে দাঁড়িয়ে আছে জীর্ণ শীর্ণ ও রোগাক্রান্ত এক যুবক। হাজতের কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবা। প্রিয় বাবাকে দেখে বহু কষ্টে কিছুটা হাসি দিলেন। আদরের সন্তানকে দেখে বাবা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কাঁদতে পারছিলেন না।
এক পলকে সন্তানের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরখ করলেন বাবা। কিন্তু এ কি অবস্থা! আদরের সন্তানের শরীরে শুধু নির্যাতনের চিহ্ন? আরেকটু কাছে গিয়ে কাঁদো কাঁদো অবস্থায় জিজ্ঞেস করলেন, তোর নখগুলো কই গেল? হাত দেখা তো, পা দেখা। তোর দুই পায়ের নখ নাই। হাতের বৃদ্ধাঙুলে দুইটা নখও নাই। আগেতো এমন আছিল না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে বাবার কাছ থেকে সন্তানকে তুলে নেয়া এক ভুক্তভোগীর ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের এমন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে। গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে এই প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। প্রতিবেদনে গুমের শিকার ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। এমনই এক গুমের শিকার ভুক্তভোগীর বাবা নিখোঁজের দুই বছর পর সন্তানকে ফিরে পেয়েছেন। তিনি ও তার সন্তান গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কাছে বর্ণনা করেছেন সেই ভয়াবহ নির্যাতনের কথা। জানান, দুই বছর আগে তার ছেলেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন স্থানে ধরনা দিয়েও সন্তানের খোঁজ পাননি। এরই মধ্যে ছেলের শোকে তার স্ত্রীও মারা যান।
হঠাৎ করেই তাকে একদিন কে বা কারা ফোন করে থানায় যেতে বলেন। ফোন পেয়ে তিনি থানায় ছুটে যান। তদন্ত কমিশনকে তিনি বলেন, দুই বছর দুই মাস পর সন্তানকে থানা হাজতে দেখতে পান। এ সময় সন্তানের এমন অবস্থা দেখে নানা প্রশ্ন করেন। কিন্তু ছেলে কোনো জবাব দেয় না। শুধু হাসে। তিনি বলেন, এ সময় দেখি ছেলের হাত ও পায়ের নখ নাই। তিনি ডিউটিরত পুলিশের কাছে গিয়ে জানতে চান, আমার ছেলেকে কোথা থেকে এনেছেন। পুলিশ জানায়, সে র্যাব হেফাজতে ছিল। সেখান থেকে থানায় পাঠানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। পুলিশ তাকে বাড়াবাড়ি না করার পরামর্শ দিয়ে উকিলের সাথে যোগাযোগ করতে বলে।
এক নজর চোখে দেখলেও ছেলেকে ছাড়িয়ে নিতে কোর্টের বারান্দায় ঘুরতে হয়েছে তাকে বহুদিন। কখনো কাশিমপুর কারাগার, আবার কখনো কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছেলেকে দেখতে ছুটে গেছেন।
বহুকষ্টে ছেলেকে ফিরে পেয়েছেন তিনি। কিন্তু অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার ছেলে এখন অসুস্থ। মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে সে। তিনি কমিশনকে জানান, মুক্তি পাওয়ার পর থেকে ছেলে মানসিকভাবে অসুস্থ। রেগে যায়। সারাক্ষণ হাসে। চিকিৎসা চলছে, তবে সে ওষুধ খেতে চায় না।
গুমের শিকার ভুক্তভোগী ছেলে কমিশনকে সেই নির্যাতনের বর্ণনা করে জানিয়েছেন, তাকে একটি অন্ধকার স্থানে আটকে রাখা হয়েছে। চোখ বেঁধে প্রতিদিন লাঠি দিয়ে পেটাতো। শরীরে যন্ত্রণায় কাতর হলেও কান্নাকাটি এবং কোনো কথা বলতে দিতো না। শুধু দিন আর রাতের কথা বলা হতো তাকে। মাঝে মাঝে চেক করা হতো অসুস্থ হয়েছি কি না।
আপনার মতামত জানানঃ