ইসলামের প্রথম যুগে নারীরা যে অসাধারণ ভূমিকা রেখে গেছেন, তা শুধু ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় নয়, বরং আজকের যুগের মুসলিম নারীদের জন্যও প্রেরণার উৎস। সেই নারীরা ছিলেন দায়িত্বশীল, আত্মমর্যাদাশীল, জ্ঞানান্বেষী, দুর্দান্ত সাহসী এবং ধর্মীয় মূল্যবোধে অবিচল—যা মানবসভ্যতার ইতিহাসে খুব কমই দেখা যায়। নবীজি (সা.)–এর তিরোধানের পর থেকে খিলাফতের বিস্তৃতি ও ইসলামের দ্রুত প্রসার—সব ক্ষেত্রেই নারীরা ছিলেন এক নীরব কিন্তু দৃঢ় শক্তি। তারা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র—তিন ক্ষেত্রেই এমন প্রভাব রেখে গেছেন, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এক অমূল্য ঐতিহ্য।
ইসলামের সূচনা পর্বে নারীদের জ্ঞানান্বেষণের মানসিকতা ছিল বিস্ময়কর। শাইখ ইউসুফ কারজাভি (রহ.) উল্লেখ করেছেন—নারীরা বিনা সংকোচে রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর কাছে ব্যক্তিগত ও সূক্ষ্ম ধর্মীয় প্রশ্ন করতেন। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) বলতেন, “আল্লাহ আনসার নারীদের প্রতি রহম করুন, লজ্জা তাদেরকে ধর্মের জ্ঞান শেখা থেকে বিরত রাখেনি।” এ থেকেই বোঝা যায়, নারীরা সেই সময়ে ধর্মীয় শিক্ষায় কতটা আগ্রহী ছিলেন। তারা বুঝতেন—জ্ঞানই জীবনকে আলোকিত করে এবং সঠিক-ভুলের পার্থক্য শেখায়; তাই দ্বীনের ব্যাপারে লজ্জা-সংকোচের কোনো স্থান নেই। সহিহ বুখারির বিভিন্ন বর্ণনায় দেখা যায়, নারীরা এমন প্রশ্নও করতেন যা আজও অনেকে বলতে সংকোচ বোধ করেন। নবীজি (সা.) তাদের প্রশংসা করতেন, কারণ তারা সত্য জানার চেষ্টা করতেন এবং আল্লাহর আদেশ বাস্তবায়নে আন্তরিক ছিলেন।
আল্লাহ যখন নারীদের পর্দা ও শালীনতার নির্দেশ দিলেন, তখন আনসার নারীরা অসাধারণ আনুগত্য দেখান। আয়েশা (রা.) বলেন—আয়াত নাজিল হওয়ার সাথে সাথে নারীরা যা কিছু কাপড়-চোপড় পেয়েছিলেন, তাই দিয়ে নিজেদের ঢেকে নিলেন। তারা অপেক্ষা করেননি, বিলম্ব করেননি। ধর্মীয় নির্দেশ আসা মাত্রই তা পালন করার উত্সাহ ছিল তাদের মধ্যে। তাদের মাথার ওপর কাপড় এমনভাবে জড়ানো ছিল যে মনে হচ্ছিল মাথার ওপর কাক বসে আছে। এটি ছিল আল্লাহর আদেশ পালনের সেই তৎপরতা, যা আজকের যুগে দেখাই কঠিন।
সেই সময়ের নারীরা স্বামীর জন্য ছিলেন সর্বোত্তম সহযোগী। আসমা বিনতে আবি বকর (রা.) ছিলেন দৃষ্টান্ত। তার স্বামী জুবাইর ইবনে আওয়াম (রা.)-এর একটি খামার ছিল মদিনার বাইরে। আসমা (রা.) প্রতিদিন সেখানে পায়ে হেঁটে যেতেন, খেজুরের আঁটি পিষে ঘোড়ার খাদ্য তৈরি করতেন, খামারের কাজ করে আবার শহরে ফিরতেন। নবীজি (সা.) একদিন তাকে দেখে নিজের উটের পেছনে তুলে আনেন—কিন্তু জুবাইর (রা.) জানতে পেরে কষ্ট পান, কারণ তিনি স্ত্রীকে এত কষ্ট করতে দেখতে পারতেন না। তবুও আসমা (রা.) স্বামীর দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এতে বোঝা যায়—ইসলামের প্রথম যুগে নারীরা সংসারের দায়িত্ব ভাগ করে নিতে কুণ্ঠিত ছিলেন না, বরং পরিবারকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সংগ্রাম করতেন।
ফাতিমা আয-যাহরা (রা.)—নবীজির অত্যন্ত প্রিয় কন্যা—তিনি নিজ হাতে ঘরের সব কাজ করতেন। এতটাই পরিশ্রম করতেন যে তাঁর হাতে যাতার দড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে ফোস্কা পড়ে যেত। যখন তিনি নবীজি (সা.)–এর কাছে একজন সাহায্যকারী চাইলেন, তিনি তাকে একটি আধ্যাত্মিক শক্তির দিক নির্দেশ করেন—ঘুমানোর আগে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ এবং আল্লাহু আকবার ৩৩ বার করে পড়তে বলেন। নবীজি বুঝিয়ে দেন—আল্লাহর স্মরণই মানুষের অভ্যন্তরে এমন শক্তি সৃষ্টি করে, যা পার্থিব ক্লান্তিকে পরাস্ত করতে সক্ষম। এই শিক্ষা শুধু ফাতিমা (রা.)–এর জন্য নয়, পরবর্তী সব মুসলিম নারীর জন্য—জীবনের কঠিন সময়ে আত্মিক শক্তির ওপর নির্ভর করার এক বিশেষ উপদেশ।
প্রথম যুগের নারীরা স্বামীদেরকে উপদেশ দিতেন—হারাম উপার্জন থেকে দূরে থাকতে। তারা বলতেন, “আমরা ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করতে পারি, কিন্তু জাহান্নামের আগুন কখনোই সহ্য করতে পারব না।” এই কথায় ছিল ধর্মীয় বিবেকের জাগরণ। একজন নারী যদি এইভাবে তার পরিবারকে নৈতিকতার মধ্যে রাখে, তবে পুরো সমাজই পবিত্রতার পথ ধরে এগোয়।
নারীরা শুধু সংসার নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের বড় বড় সিদ্ধান্তেও প্রভাব রেখেছেন। যুদ্ধের মতো কঠিন পরিস্থিতিতে তারা স্বামীদেরকে নিরুৎসাহিত না করে বরং উদ্দীপ্ত করতেন। তারা জানতেন—জীবন-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। জিহাদে অংশগ্রহণকারী পুরুষদের উদ্দেশে একজন দৃঢ়চিত্ত নারী বলতেন, “আল্লাহ তো আছেন!” এই বিশ্বাসই তাদের সন্তানকে নৈতিকতার আলোয় গড়ে তুলত।
জাহেলি যুগের কবি খানসা (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর এক অনন্য রূপ ধারণ করেন। তাঁর চার পুত্র কাদিসিয়ার যুদ্ধে শহীদ হলে তিনি শোকাভিভূত না হয়ে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন—কারণ তাঁর সন্তানরা আল্লাহর পথে জীবন দিয়েছে। এটি ছিল তাঁর ইমানের দৃঢ়তার প্রতিচ্ছবি।
আসমা বিনতে আবি বকর (রা.) তাঁর সন্তান আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.)–কে আত্মসমর্পণের পরিবর্তে সত্যের পক্ষে অটুট থাকার উপদেশ দেন। তিনি বলেন, “মেষ জবাইয়ের পর যদি তার চামড়া ছাড়ানো হয়, তাতে মেষের আর কোনো ক্ষতি হয়?” অর্থাৎ মৃত্যুর পর দেহের অবমাননা কোনো গুরুত্ব বহন করে না, সত্যের ওপর স্থির থাকা-ই মূল বিষয়। এই ছিল প্রাথমিক যুগের নারীদের সত্যনিষ্ঠতা ও সততা।
ইসলাম নারীর জ্ঞানার্জনকে বাধ্যতামূলক করেছে। যারা ইতিহাসের কোনো কোনো সময়ে নারীদের অজ্ঞতায় রাখতে চেয়েছেন, তারা নিজেরাই অজ্ঞ—ইসলাম কখনো নারীর অগ্রযাত্রাকে নিস্তব্ধ হতে বলেনি। আয়েশা (রা.) ছিলেন অসাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন। সহাবীদের বড় বড় আলেমরা তাঁর কাছে হাদিস শিখতেন ও ফিকহ সমস্যার সমাধান নিতেন। তিনি ভুল সংশোধন করতেন, যুক্তি দিতেন এবং ইলমের মজলিস পরিচালনা করতেন। ইমাম জারকাশি তাঁর সংশোধনগুলো নিয়ে একটি বইও রচনা করেন—যা আজও জ্ঞানচর্চার গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
ইমাম শাফেয়ী (রহ.)–এর মতো আলেমও সাকিনা বিনতে হুসাইন (রা.)–এর মজলিসে উপস্থিত ছিলেন বলে উল্লেখ আছে। বিখ্যাত হাদিস বিশারদ ইবনে হajar আল-আসক্বালানি তাঁর শিক্ষকদের তালিকায় বহু নারীকে উল্লেখ করেছেন। হানাফি মাজহাবের একজন প্রবীণ আলেমের কন্যা তো পিতার সাথে ফতোয়ায় স্বাক্ষর করতেন—এটি ছিল ইসলামী সভ্যতার জ্ঞান-বিন্যাসে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের অনন্য উদাহরণ।
ইসলামের প্রথম যুগের নারীরা কখনো নিজেকে অবহেলিত বা অক্ষম ভাবেননি। বরং তাদের আত্মবিশ্বাস, জ্ঞান, ইমান ও দাওয়াতি দায়িত্ববোধ ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। তারা জানতেন—ইসলাম তাদেরকে সম্মানিত করেছে, মানবজীবনের সব ক্ষেত্রে অবদান রাখার সুযোগ দিয়েছে। আজকের যুগের মুসলিম নারীদেরও তাদের ঐতিহ্য থেকে শক্তি নিতে হবে। তারা যেন বুঝতে পারে—নারী কখনোই শুধু গৃহবন্দী কোনো সত্তা নয়; বরং পরিবার, সমাজ, জ্ঞান ও সংস্কৃতির নির্মাতা। যদি তারা প্রথম যুগের নারীদের মতো আল্লাহর পথে দৃঢ়চিত্ত হয়, তবে সমাজে আলোর বিস্তার নিশ্চিত হবে।
আজ দরকার সেই আত্মবিশ্বাস, সেই জ্ঞানান্বেষণ, সেই দাওয়াতি দায়িত্ববোধ এবং সেই দৃঢ় বিশ্বাস—যার ওপর দাঁড়িয়ে প্রথম যুগের নারীরা এক সোনালি ইতিহাস গড়ে তুলেছিলেন। আধুনিক নারীর হাতেই আছে সেই ঐতিহ্যের নতুন অধ্যায় রচনার সুযোগ।
আপনার মতামত জানানঃ