
ইতিহাস বলে, কোনো সভ্যতার উত্থান কখনোই আকস্মিক নয়—আর পতনও নয় হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা। মুসলিম সাম্রাজ্যগুলোর ইতিহাসও এর ব্যতিক্রম নয়। একসময় যে মুসলমানরা বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, নৌবিজ্ঞান ও প্রশাসনের শীর্ষে ছিল, সেই বিশ্বশক্তির ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ দিনের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, ক্ষমতার লড়াই এবং বিলাসিতার দিকে অতিরিক্ত ঝোঁক। উমাইয়া থেকে আব্বাসি, সেলজুক থেকে ফাতেমি, আর অটোমান থেকে মোগল—প্রায় সব সাম্রাজ্যের পতনের বুনিয়াদ একই ধরনের ভুলে গঠিত।
উমাইয়া সাম্রাজ্যে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা থাকলেও ক্ষমতা পরিবারের ভেতরে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ায় সাধারণ মানুষ ও ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে। আব্বাসিদের স্বর্ণযুগে বিজ্ঞান ও শিল্পকলার নতুন মাত্রা যুক্ত হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজপ্রাসাদের বিলাসিতা, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র পুরো সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে দেয়। রাজসভার ভেতরের খণ্ড-বিখণ্ডতা এবং তুর্কি, আরব ও পারসিদের মধ্যকার বৈরিতা কেন্দ্রীয় শাসনকে অকার্যকর করে তোলে।
অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসেও একই প্যাটার্ন দেখা যায়। দীর্ঘ পাঁচ শতাব্দীর এই শক্তিমান রাষ্ট্রও শেষদিকে নেতৃত্ব সংকট, দুর্নীতিগ্রস্ত দাফতরিক ব্যবস্থা এবং রাজপ্রাসাদের অতি বিলাসের ফলে জর্জরিত হয়ে ওঠে। জেনিচারি বাহিনীর বিদ্রোহ, দরবারের হুরেম-রাজনীতি, এবং যোগ্যতার পরিবর্তে দরবারপৃষ্ঠপোষকতার ভিত্তিতে প্রশাসন পরিচালনা—এসবই সাম্রাজ্যটির ভিতকে দুর্বল করে দেয়। প্রতিরক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চা অবহেলিত হওয়ায় ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের সময় মুসলিম বিশ্ব সামরিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে বহু ধাপ পিছিয়ে পড়ে।
সব সাম্রাজ্যের সাধারণ ভুল ছিল—ক্ষমতার লড়াই, দুর্নীতি, প্রশাসনিক অবহেলা, অভিজাতদের জৌলুসপ্রিয়তা, জাতিগত বৈষম্য এবং জ্ঞানের পরিবর্তে আরাম-আয়েশকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এর ফলেই মুসলিম সভ্যতা ধীরে ধীরে বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক ও সামরিক উৎকর্ষতা হারায়। যে সভ্যতা কখনো জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়া থেকে বাগদাদ, দামেস্ক থেকে করাচি পর্যন্ত, সেই সভ্যতা অচিরেই পরিণত হয় বিভাজিত ও দুর্বল রাষ্ট্রসমূহে।
ইতিহাসের এই অধ্যায় মুসলিম বিশ্বের জন্য এক কঠিন শিক্ষা—উন্নতির জন্য প্রয়োজন ন্যায়নিষ্ঠ প্রশাসন, জ্ঞানচর্চা, আত্মসংযম এবং নেতৃত্বে যোগ্যতা। যখনই একটি জাতি বিলাসিতা, দুর্নীতি ও ক্ষমতার লড়াইকে মূল্যবোধের জায়গায় বসায়, তখনই পতনের কণা নেমে আসে নিঃশব্দে। মুসলিম সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাস আমাদের শেখায়—সভ্যতার শক্তি কেবল বাহ্যিক নয়, বরং অভ্যন্তরীণ নৈতিক ভিত্তিতেও নির্ভরশীল।
আপনার মতামত জানানঃ