ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক এই শেষ কয়েক মাসে যেমন খাদের কিনারায় পৌঁছেছে, তাতে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাঞ্চল্য, রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সামাজিক বিবাদ একসাথে মোড় নিয়েছে। শুধুমাত্র সাম্প্রতিক নয়াদিল্লির বিক্ষোভ বা হাইল কমিশনের সামনে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর কর্মসূচিই নয়—সম্পর্কের এই জটিল অবনতি দীর্ঘদিন ধরে গঠিত রাজনৈতিক, নিরাপত্তা, ঐতিহাসিক ও লোকস্বভাবের ফসল। এই অবনতি কেবল ঢাকা-দিল্লির রাজনীতিক দ্বন্দ্ব নয়, বরং দুই দেশের জনমত, মতাদর্শিক বিভাজন ও অভ্যন্তরীণ সংকটও আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিফলিত হচ্ছে।
সবশেষ পরিস্থিতি আরও একটি উদ্বেগের পরতে জড়িয়েছে যখন নয়াদিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) ও বজরং দলসহ বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিক্ষোভ করে। তারা বাংলাদেশের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন ও ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে হাইকমিশন ঘিরে প্রচন্ড নিরাপত্তা সহ বিক্ষোভ করেন; এতে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীকে মোতায়েন করতে হয়। এই বিক্ষোভে প্রোটেস্টকারীরা পুলিশ ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করে এবং বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ গড়ে ওঠে, যা কূটনৈতিক পরিবেশকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে।
এই ঘটনার পেছনের সরাসরি ঘটনাটিই হলো ময়মনসিংহে দীপু চন্দ্র দাস নামে এক হিন্দু পোশাক শ্রমিককে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা এবং তাঁর মরদেহ জ্বালিয়ে দেওয়া। এর ফলে ভারতে বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ হয়, বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বিশাল সংখ্যায় মানুষ জমায়েত হয় এবং বাংলাদেশী মিশনগুলোর নিরাপত্তা ও কনস্যুলার কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়—যা সম্পর্কের মাত্রাকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
এ পরিস্থিতি একক কোনো ঘটনা নয়; বরং এটি ২০২৫ সালের সামগ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতার একটি অংশ। ডিসেম্বর ২০২৫-এর বিশাল সহিংসতায় হেডলাইন ছিলো ওসমান হাদির মৃত্যুর পর গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে মব হামলা ও ভারতবিরোধী স্লোগান। এই সহিংসতা ধর্ম, রাজনীতি ও দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে বড় উদ্বেগ তুলে ধরে। যুদ্ধাপরাধ ইস্যু, রাজনৈতিক নেতাদের নির্বাসন, বাংলাদেশে ভারত-সম্পর্কিত বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভূমিকা—এসব নিয়ে জনমত ইতিমধ্যেই তীব্র বিভক্ত। বাংলাদেশে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী/রাজনীতিবিদদের আশ্রয় ও নির্যাতন ইস্যু গ্রহণগত ভাবে নেতিবাচক পর্যালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে, যা দিল্লি-ঢাকার সম্পর্ককে আরো সংকটে ফেলেছে।
এই বিক্ষোভ ও কূটনৈতিক বিপর্যয়ের পেছনে আরো গভীর কারণে রয়েছে রাজনৈতিক পরিবর্তন ও লোকে ভারতকে একটি ব্যর্থ সহযোগী দেশ হিসেবে দেখার প্রবণতা। ২০২৪-এর আগস্টে আওয়ামী লীগের পতনের পর প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন, এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সময় শুরু হয় ভারত-সম্পর্কিত কিছু বিষয় নিয়ে উত্তেজনা। বাংলাদেশি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানিয়েছেন, ভারতের কাছে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের অনুরোধ এখনও বিশেষ সাড়া পাচ্ছে না, যা ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের ফিরতি প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে।
সম্পর্কের অবনতির পেছনে ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত ইতিহাস ও ভূমিকা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ও বর্ষাকালে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর কিছু ঘটনা আঞ্চলিক নিরাপত্তা দৃশ্যকে প্রভাবিত করেছে; উদাহরণ — ২০২৪ সালের ডিসেম্বরেই ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের ওপর হিন্দু উগ্রবাদী সংগঠন হামলা চালায়, যা ধ্বজা অবমাননা ও কূটনৈতিক বিরোধের ঘটনাতে রূপ নিতে পারে।
এ সকল ঘটনা মিলিয়ে দেখা যায়, একটি বড় চিত্র তৈরি হয়েছে যেখানে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অভ্যন্তরীণ সংকটকে ভারত-সম্পর্কিত অভিযোগ ও অন্তর্দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ভারতে আশ্রয় নেওয়া রাজনৈতিক নেতাদের নিয়েও সমালোচনা চলছে, এবং কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষা ব্যবহার করে যা দু’দেশের মধ্যে আতঙ্ক ও সঙ্কোচ তৈরি করছে। এই বাগাড়ম্বর শুধুমাত্র রাজনৈতিক মুখোশ; বরং জনমত, সামাজিক মাধ্যম, সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ভারত-সম্পর্কিত ইস্যুকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, যার ফলে দ্বিপক্ষীয় আস্থা ও সংযোগ দুর্বল হচ্ছে।
আমদানি-রপ্তানি, বাণিজ্য, বিদ্যুৎ ও পেট্রোলিয়াম সহ অসংখ্য বাস্তব সহযোগিতার ক্ষেত্র থাকলেও, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুই দেশের সম্পর্কের স্বস্তি বিরাট চ্যালেঞ্জে পড়েছে। বহুদিন ধরে বাংলাদেশের বিমসটেক ও অন্যান্য আঞ্চলিক কাঠামোর অধীন ভারতের সঙ্গে সংহতির প্রতি অঙ্গীকার থাকলেও, সাম্প্রতিক সময়ে এই লক্ষ্য প্রকট সংকটে পড়ে গেছে।
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা যেমন বাংলাদেশে সমালোচনা ও সহিংসতা বৃদ্ধি করেছে, তেমনি ভারতের কিছু অংশে প্রবাসী সমস্যা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে প্রতিক্রিয়া শক্তিশালী হয়েছে। এই সমন্বয়হীনতার কারণে কূটনৈতিক স্তরেও সমস্যা দেখা দিয়েছে; বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বারংবার ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করেছে নিরাপত্তা ও সহিংসতার বিষয়ে উদ্বেগ জানাতে।
এই পরিস্থিতি অতি সংবেদনশীল—একদিকে ঢাকা-দিল্লির আন্তঃসরকারী সম্পর্কের প্রাতিষ্ঠানিক সংযোগ টিকে থাকার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে জনমত, রাজনৈতিক শক্তি ও নিরাপত্তা দিক থেকে সম্পর্কের ওপর চাপ বিরাজ করছে। কয়েক দশক আগে উভয় দেশ যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার মধ্য দিয়ে গড়েছে—যেমন সীমান্ত নিরাপত্তা, বাণিজ্য, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়—সে সম্পর্কটি আজ নানা অভ্যন্তরীণ ও বাইরের কারণে ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
আজকের এই অবনতির পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, অভ্যন্তরীণ সহিংসতা, হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর প্রতিবাদ, কূটনৈতিক ইস্যু ও ভারত-বিরোধী রাজনৈতিক বয়ান—এসব মিলিতভাবে ভূমিকা রাখছে। এই পরিস্থিতি যদি অল্প সময়ের মধ্যে স্থিতিশীল না হয়, তা হলে দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের শ্রেষ্ঠত্বের ঐতিহ্য ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিপন্ন হয়ে পড়বে।
আপনার মতামত জানানঃ