ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক ও সামাজিক সংবেদনশীলতার কেন্দ্রবিন্দু। পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের মতো রাজ্যে এই সীমান্ত পরিস্থিতি সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। সম্প্রতি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় মুসলিম জনসংখ্যার পরিবর্তন নিয়ে যে জরিপ শুরু করেছে, তা নতুন করে বিতর্ক তৈরি করেছে। সীমান্তের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে জনসংখ্যার প্রবণতা বোঝার নামে এই জরিপ অনেকের কাছে আসন্ন নির্বাচনের আগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভয় দেখানোর একটি কৌশল বলে মনে হচ্ছে। সরকারি পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এটি নিয়মিত গোয়েন্দা বিশ্লেষণের অংশ, যাতে সীমান্তে উগ্রপন্থি উপাদানের উপস্থিতি বা বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশের বিষয়টি বোঝা যায়। কিন্তু সময় এবং প্রেক্ষাপটের কারণে বিরোধী দল ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন এর অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে।
ভারতের রাজনীতিতে অভিবাসন এবং নাগরিকত্ব প্রশ্ন দীর্ঘদিন ধরেই তর্ক-বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে বিজেপি বারবার বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশের প্রসঙ্গ তুলে আসছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সরাসরি অভিযোগ করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস রাজনৈতিক স্বার্থে অবৈধ অনুপ্রবেশকে উৎসাহ দিচ্ছে। সীমান্ত এলাকায় ভোটারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াকে বিজেপি এই অভিযোগের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের দাবি, কয়েকটি নির্বাচনী আসনে হঠাৎ ভোটার তালিকার সংখ্যা বেড়ে যাওয়া প্রমাণ করে বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে এবং তাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে বিরোধীরা মনে করছে, বিজেপি এই ধরনের দাবি ও জরিপের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছে এবং মুসলিমদের ধর্মীয় প্রোফাইলিং করে নির্বাচনে ফায়দা লুটতে চাইছে।
বর্তমান জরিপের আরেকটি মাত্রা হলো পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকা পুনর্বিবেচনার পরিকল্পনা। নির্বাচন কমিশন ‘বিশেষ নিবিড় পুনর্বিবেচনা’ বা এসআইআর চালুর কথা ভাবছে, যেখানে ভোটারদের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য নথি দেখাতে হতে পারে। বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, এটি আসলে ভোটার তালিকা কারচুপির একটি কৌশল। বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে, যা ইতিমধ্যে আসামে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। সেখানে বহু মানুষ, বিশেষ করে মুসলিমরা, নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে না পারায় সমস্যায় পড়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের সীমান্ত অঞ্চলে জনসংখ্যার গঠন নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার নতুন পর্যবেক্ষণ তাই অনিবার্যভাবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে।
গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। অতীতেও এমন জরিপ হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় নতুন মসজিদ ও মাদ্রাসার সংখ্যা বৃদ্ধির তথ্য তাদের নজরে এসেছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোনো উগ্রপন্থি গোষ্ঠী ব্যবহার করছে কিনা, তা খতিয়ে দেখাই মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, যদি সত্যিই নিরাপত্তা বিষয়ক জরিপ হয়, তবে হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলেও তা সমানভাবে হওয়ার কথা ছিল। কেবল মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোকে টার্গেট করায় বোঝা যায় যে এর নেপথ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। একজন সাবেক আইবি কর্মকর্তা সরাসরি বলেছেন, নির্বাচনের ঠিক আগে এই ধরনের পদক্ষেপ সংখ্যালঘুদের মনে ভীতি তৈরি করার জন্যই নেওয়া হয়েছে। এর ফলে মুসলিমরা মনে করতে পারে, তাদের ওপর বিশেষভাবে নজরদারি চালানো হচ্ছে, যেন তারা সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে।
ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী বা বিএসএফ আগেও এ ধরনের অভিযোগের মুখে পড়েছে। ২০১৮ সালে তারা রাজস্থানের জয়সালমিরে পাকিস্তান সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় মুসলিম জনসংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির রিপোর্ট করেছিল। সেই রিপোর্টে স্থানীয় মসজিদের সংখ্যা বৃদ্ধিকে সন্দেহজনক বলে উল্লেখ করা হয়। অভিযোগ ওঠে যে, ধর্মীয় প্রোফাইলিং-এর ভিত্তিতে সেই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছিল। একই কৌশল এবারও বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা রাজ্যগুলোতে অনুসরণ করা হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিজেপির রাজনৈতিক প্রচারণায় অভিবাসন ইস্যুটি সবসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পশ্চিমবঙ্গে তারা বারবার বলেছে যে, তৃণমূল সরকারের প্রশ্রয়ে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি প্রবেশ করছে। মোদি সরাসরি বলেছেন, এই অনুপ্রবেশকারীরা দেশের সম্পদ ও অবকাঠামোর ওপর চাপ সৃষ্টি করছে এবং পশ্চিমবঙ্গকে রক্ষা করতে হলে বিজেপিকে ভোট দিতে হবে। একই সঙ্গে তিনি অভিযোগ করেছেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিম ভোটব্যাংকের কথা মাথায় রেখে এই অনুপ্রবেশকে উৎসাহ দিচ্ছেন। অন্যদিকে বিরোধীরা মনে করছে, বিজেপি ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটাচ্ছে। নাগরিকপঞ্জি, বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ, তৃণমূলের তুষ্টিকরণের রাজনীতি—এসব ইস্যু ব্যবহার করে বিজেপি নির্বাচনে মেরুকৃত ভোটে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে।
রাজনৈতিক এই বিতর্কের পাশাপাশি বাস্তব পরিস্থিতিও উপেক্ষা করা যায় না। সীমান্তবর্তী এলাকায় অনেক মানুষই প্রতিদিন সীমান্ত পেরিয়ে আসা-যাওয়া করেন। তাদের কেউ কেউ কাজের খোঁজে আসে, কেউবা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে আসে। সীমান্ত এত বিশাল যে, তা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব। এই বাস্তবতায় অনুপ্রবেশের অভিযোগ অস্বাভাবিক নয়, তবে এর রাজনৈতিক ব্যবহারই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
বাংলা ভাষাভাষী শ্রমিকদেরও সাম্প্রতিক সময়ে অন্য রাজ্যে হয়রানির মুখে পড়তে হয়েছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে শত শত শ্রমিককে আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে, যাদের বেশির ভাগই মুসলিম। অনেককে বাধ্য হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসতে হয়েছে। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে। সংখ্যালঘুরা নিজেদের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কায় ভুগছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় মুসলিম জনসংখ্যার পরিবর্তন নিয়ে গোয়েন্দা জরিপকে যদি নিরাপত্তা বিশ্লেষণের বাইরে দেখা হয়, তবে এটি কেবল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হচ্ছে। এটি একদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করছে, অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভোটারদের মধ্যে এই ধারণা জোরদার করছে যে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা তাদের সংস্কৃতি ও সম্পদের ওপর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এইভাবে বিজেপি তাদের নির্বাচনী প্রচারণার সঙ্গে নিরাপত্তা বিষয়টিকে একাকার করে তুলছে।
অন্যদিকে প্রশ্ন উঠছে, প্রকৃত নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলায় এই ধরনের ধর্মভিত্তিক প্রোফাইলিং কতটা কার্যকর। একজন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেছেন, এটি আসলে অকার্যকর পুলিশি কৌশল এবং করদাতাদের অর্থের অপচয়। বাস্তবে উগ্রপন্থি কার্যকলাপের সঙ্গে সাধারণ মুসলিম জনগণের কোনো যোগসূত্র নেই। কিন্তু এই ধরনের জরিপে পুরো সম্প্রদায়কে সন্দেহের চোখে দেখা হলে তা সামাজিক বিভাজন ও অবিশ্বাস তৈরি করে।
সব মিলিয়ে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সীমান্ত সংলগ্ন মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে জনসংখ্যার পরিবর্তন নিয়ে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার পর্যবেক্ষণকে নিছক নিরাপত্তা জরিপ হিসেবে দেখা কঠিন। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, বিজেপির প্রচারণা, নির্বাচন সামনে রেখে মেরুকরণের কৌশল—সবকিছু মিলিয়ে এটি আরও একটি পদক্ষেপ, যা সংখ্যালঘুদের মনে ভয় সঞ্চার করছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে। সীমান্ত নিরাপত্তা ও অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তবে তা যদি ধর্মীয় প্রোফাইলিং-এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়, তবে সমাজে বিভাজন ও অনাস্থাই বাড়বে। ভারতের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এ ধরনের প্রবণতা কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, তা ভবিষ্যতই বলে দেবে।
আপনার মতামত জানানঃ