ভিক্টোরিয়ান যুগে (১৮৩৭–১৯০১) নারীদের জীবন ছিল কঠোর সামাজিক বিধি, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য এবং সীমিত স্বাধীনতার মধ্যে আবদ্ধ। এই সময়টি ব্রিটিশ ইতিহাসে শিল্পবিপ্লব, সাম্রাজ্য বিস্তার ও নৈতিকতার কড়া সংজ্ঞার জন্য পরিচিত হলেও নারীদের জন্য এটি ছিল মূলত নিয়ন্ত্রিত ও পুরুষকেন্দ্রিক এক সমাজব্যবস্থা।
ভিক্টোরিয়ান সমাজে নারীর প্রধান পরিচয় নির্ধারিত হতো স্ত্রী, মা ও গৃহকর্ত্রী হিসেবে। “আদর্শ নারী” বলতে বোঝানো হতো এমন একজনকে, যিনি নীরব, বিনয়ী, ধর্মভীরু ও আত্মত্যাগী। নারীর স্থান ছিল ঘরের ভেতরে, আর পুরুষের স্থান বাইরের জগতে—এই ধারণাকে বলা হতো “separate spheres” বা পৃথক ক্ষেত্রের তত্ত্ব। এর ফলে নারীরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা থেকে প্রায় পুরোপুরি বাদ পড়ে যেতেন।
আইনগত দিক থেকে নারীদের অবস্থান ছিল অত্যন্ত দুর্বল। বিয়ের পর একজন নারী কার্যত তার আইনি সত্তা হারাতেন। এই ব্যবস্থাকে বলা হতো Coverture। এর ফলে স্বামীর অধীনে চলে যেত স্ত্রীর সম্পত্তি, আয় এবং এমনকি সন্তানদের ওপর অধিকারও। কোনো নারী নিজ নামে চুক্তি করতে পারতেন না, মামলা করতে পারতেন না, এমনকি নিজের উপার্জনের ওপরও তার নিয়ন্ত্রণ থাকত না। পরে ১৮৭০ ও ১৮৮২ সালের Married Women’s Property Acts কিছুটা পরিবর্তন আনলেও যুগের বড় অংশজুড়েই নারীরা আইনি ভাবে নির্ভরশীল ছিলেন।
শিক্ষার ক্ষেত্রেও নারীরা ছিলেন বঞ্চিত। উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়েরা বাড়িতে গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে পড়াশোনা করতেন, তবে তা সীমাবদ্ধ ছিল সাহিত্য, সংগীত, আঁকাআঁকি ও শিষ্টাচার পর্যন্ত—যাকে বলা হতো “accomplishments”। বিজ্ঞানের মতো বিষয় বা উচ্চশিক্ষা নারীদের জন্য প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। মধ্য ও নিম্নবিত্ত নারীদের জন্য শিক্ষার সুযোগ আরও সীমিত। ১৯ শতকের শেষভাগে কিছু নারী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের সুযোগ পেলেও সামাজিক বাধা ছিল প্রবল।
কর্মক্ষেত্রে নারীদের সুযোগ ছিল অল্প ও নিম্নমানের। অধিকাংশ কর্মজীবী নারী কাজ করতেন গৃহকর্মী, সেলাইশ্রমিক, কারখানার শ্রমিক বা দোকানের সহকারী হিসেবে। কর্মঘণ্টা দীর্ঘ, মজুরি কম এবং কাজের পরিবেশ ছিল অস্বাস্থ্যকর। অনেক নারীকে বাধ্য হয়ে যৌনকর্মে জড়াতে হতো, যা সমাজে ভয়ংকর কলঙ্ক হিসেবে বিবেচিত ছিল। অথচ একই সমাজ সেই নারীদের কোনো সুরক্ষা বা বিকল্প দিত না।
ভিক্টোরিয়ান যুগে নারীর যৌনতা ছিল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ও প্রায় নিষিদ্ধ আলোচ্য বিষয়। বিবাহপূর্ব যৌনতা নারীর জন্য ভয়াবহ সামাজিক শাস্তির কারণ হতো, কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে একই আচরণ অনেকটাই উপেক্ষিত ছিল। নারীদের বলা হতো তারা “স্বভাবতই যৌন আকাঙ্ক্ষাহীন”, যা মূলত পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণকে নৈতিকতার আড়ালে বৈধতা দিত। মাতৃত্বকে নারীর চূড়ান্ত দায়িত্ব হিসেবে দেখা হতো, কিন্তু প্রসবকালীন চিকিৎসা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ এবং মাতৃমৃত্যুর হার ছিল অত্যন্ত বেশি।
পোশাকও ছিল নারীর ওপর নিয়ন্ত্রণের একটি বড় মাধ্যম। করসেট, ভারী স্কার্ট ও আঁটসাঁট পোশাক নারীর চলাফেরা ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করত। করসেট ব্যবহারের ফলে শ্বাসকষ্ট, অঙ্গবিকৃতি ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ছিল সাধারণ। তবু সামাজিক মর্যাদা রক্ষার জন্য এসব পোশাক পরা বাধ্যতামূলক ছিল।
তবে এই দমনমূলক বাস্তবতার মধ্যেই ভিক্টোরিয়ান যুগে নারীদের প্রতিরোধ ও পরিবর্তনের সূচনাও দেখা যায়। ১৯ শতকের মাঝামাঝি থেকে নারী অধিকার আন্দোলন গড়ে উঠতে শুরু করে। সম্পত্তির অধিকার, শিক্ষার সুযোগ এবং ভোটাধিকারের দাবিতে নারীরা সংগঠিত হন। এমিলিন প্যাঙ্কহার্স্টের মতো নেত্রীরা পরে সাফ্রাজেট আন্দোলনের মাধ্যমে নারীদের রাজনৈতিক অধিকার প্রশ্নে সমাজকে নাড়িয়ে দেন।
সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও নারীরা ধীরে ধীরে নিজেদের কণ্ঠ খুঁজে পান। শার্লট ব্রন্টে, এমিলি ব্রন্টে, জর্জ এলিয়ট (ছদ্মনাম)–এর মতো লেখিকারা পুরুষ ছদ্মনামে হলেও নারীর অভিজ্ঞতা ও মানসিক দ্বন্দ্বকে সাহিত্যে তুলে ধরেন। এটি ভিক্টোরিয়ান সমাজের ভেতরেই পরিবর্তনের বীজ বপন করে।
সব মিলিয়ে ভিক্টোরিয়ান যুগে নারীদের জীবন ছিল বৈষম্য, নিয়ন্ত্রণ ও নীরব সংগ্রামের ইতিহাস। এটি একদিকে দমনমূলক সামাজিক কাঠামোর প্রতিচ্ছবি, অন্যদিকে আধুনিক নারী অধিকার আন্দোলনের জন্মকাল। এই যুগের নারীদের লড়াই ও অভিজ্ঞতাই পরবর্তী শতকে নারীদের স্বাধীনতা ও সমতার পথ তৈরি করে দেয়।
আপনার মতামত জানানঃ