ওয়াশিংটন ও মস্কোর সম্পর্ক সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যেভাবে দ্রুত অবনতি হয়েছে, তাতে অনেকের মাঝেই প্রশ্ন উঠেছে—ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত কূটনীতি বা রাজনৈতিক যোগাযোগ কি আদৌ কাজ করছে? দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতে তিনি দৃঢ়ভাবে দাবি করেছিলেন, ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তার সম্পর্কই ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর চাবিকাঠি হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যুদ্ধ এখনো পুরোপুরি জারি আছে, আর দুই বিশ্বশক্তি হুমকি ও পাল্টা হুমকির মধ্যেই নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি রাশিয়ার তেল কোম্পানি রসনেফট ও লুকঅয়েল-এর ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। অপরদিকে রাশিয়া তাদের পারমাণবিক সক্ষমতা বাড়ানোর ইঙ্গিত দিতে বুরেভেস্টনিক ক্রুজ মিসাইল ও পোসাইডন আন্ডারওয়াটার ড্রোনের পরীক্ষা চালিয়েছে। এ ছাড়াও দুই দেশই ইঙ্গিত দিয়েছে—তারা পারমাণবিক পরীক্ষা পুনরায় শুরু করতে পারে। এসব ইঙ্গিতই বলে দেয়, উত্তেজনার মাত্রা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় তীব্র।
ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম দিকে পুতিনের সঙ্গে ব্যক্তিগত সংলাপ বাড়ানোর চেষ্টা করেন। বহুদিন পর দুই দেশের মধ্যে সরাসরি আলোচনা শুরু হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও পুতিনের নিয়মিত ফোনালাপ হয় এবং গত আগস্টে আলাস্কায় একটি শীর্ষ বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। তবু কূটনৈতিক অগ্রগতি প্রায় নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা অ্যান্ড্রু পিকের ভাষায়, এখন পর্যন্ত একমাত্র সফলতা হলো—সংলাপ অন্তত চলছে। কিন্তু সংলাপ চলা আর ফল পাওয়া—এ দুটি ভিন্ন বাস্তবতা।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকেও ট্রাম্প স্পষ্টতই হতাশ ছিলেন। তিনি এমনকি সতর্ক করে বলেন, “তোমরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলছ।” তবু জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় অংশীদাররা ট্রাম্পকে সন্তুষ্ট রাখতে নিজেদের পদক্ষেপকে নমনীয় রেখেছে। কারণ তাদের জন্য জরুরি হলো এই যুক্তি তুলে ধরা যে পুতিনের শর্ত মেনে নেওয়া মানে ইউরোপীয় নিরাপত্তাকেই বিপন্ন করা।
ট্রাম্প মূলত ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও ব্যক্তিগত দূত ব্যবহার করে সংকট সমাধানের চেষ্টা করেছেন। নিউ ইয়র্কের রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়িক ঘনিষ্ঠ বন্ধু স্টিভ উইটকফকে তিনি বিশেষ দূত হিসেবে পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করতে পাঠান। প্রতিটি সফরের পরই দাবি করা হয়েছিল যে দুই পক্ষ সমঝোতার কাছাকাছি। কিন্তু কূটনৈতিক মহলে উইটকফের অভিজ্ঞতা নিয়ে উদ্বেগ ছিল। ইউরোপের জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকদের মতে, উইটকফ মস্কোতে গিয়ে ভুল ধারণা নিয়ে বসতেন—তিনি ভাবতেন পুতিন ছাড় দেবেন। অথচ বাস্তবে ক্রেমলিনের অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ উল্টো দিকে।
রাশিয়ার এক সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, উইটকফ রাশিয়ার অবস্থানের সূক্ষ্মতা বুঝতে পারতেন না। ফলে হোয়াইট হাউস ও ক্রেমলিন প্রায়ই ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলত। দু’পক্ষের ভুল বোঝাবুঝি আলাস্কার বৈঠকে চূড়ান্ত রূপ নেয়। বৈঠক আচমকা সংক্ষিপ্ত করা হয়, কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই। পরে ট্রাম্প ও পুতিন সংবাদ সম্মেলনে হাজির হলেও ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের কোনো রূপরেখা ঘোষণা করেননি। গোপনে কী ঘটেছিল তা দুই দেশই স্পষ্ট করেনি।
ফিনান্সিয়াল টাইমস জানায়, ট্রাম্প ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা এবং বাণিজ্য বাড়ানোর প্রস্তাব দেন। কিন্তু পুতিন তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি পুরো ডনবাস অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ, ইউক্রেনের নিরপেক্ষতা, সেনাবাহিনী কমানো, রুশ ভাষার সাংবিধানিক সুরক্ষা এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারসহ পাঁচটি বড় দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন। ওয়াশিংটন ও কিয়েভের কাছে এগুলো একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
ট্রাম্প মূলত ভূখণ্ডগত আপোষের দিকেই বেশি ঝুঁকেছিলেন। এপ্রিলেই তিনি বলেন, “ক্রাইমিয়া রাশিয়ার মতোই থাকবে।” গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, তার দল এ অঞ্চলের রাশিয়া দখল স্বীকৃতির সম্ভাবনাও বিবেচনা করেছিল। এমনকি অক্টোবরের বৈঠকেও তিনি জেলেনস্কির কাছে ‘অঞ্চল বিনিময়’ প্রস্তাব তোলেন। কিয়েভ অবশ্য এসব প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি, তবে ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখতে সরাসরি বিরোধও এড়িয়ে গেছে।
রাশিয়া সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ফ্রন্টলাইনের যেখানেই সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল, সেখান থেকেই দরকষাকষির ইঙ্গিত দিয়েছে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, দক্ষিণ ইউক্রেনের বর্তমান ফ্রন্টলাইন ধরে মস্কো হয়তো সমঝোতায় রাজি হতে পারে। কিন্তু ডনবাস অঞ্চল নিয়ে রাশিয়া কঠোর অবস্থানে। কারণ অঞ্চলটি খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ এবং রাশিয়ার রাজনৈতিক বর্ণনায় ‘ঐতিহাসিক দায়িত্বের’ অংশ।
ইউরোপীয় কূটনীতিকরা মনে করেন, ট্রাম্প এখানে একটি মৌলিক ভুল করেছিলেন। তিনি বিষয়টিকে একধরনের “রিয়েল এস্টেট চুক্তি”—ভূখণ্ড বিনিময়ের লেনদেন হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু পুতিনের কাছে এটি শুধু ভূখণ্ডের প্রশ্ন নয়, বরং ইউক্রেনকে তাঁর প্রভাববলয়ে ফেরানোর বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রকল্প। তাই কিয়েভের রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা ও সামরিক সক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা—এটাই মস্কোর আসল লক্ষ্য।
এই অচলাবস্থার মধ্যে ট্রাম্প-পুতিনের দ্বিতীয় বৈঠক আয়োজনের উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও সের্গেই লাভরভ শুধুমাত্র একবার কথা বলেন; এরপর আর কোনো বৈঠক এগোয়নি। কারণ লাভরভের ভাষায়, “মার্কিনরা বুঝতেই চায় না রাশিয়ার মৌলিক অবস্থান বদলায়নি।”
রাশিয়া আবারও তাদের আগের দাবিগুলো সম্বলিত বিশদ স্মারকলিপি পাঠায়, যা দেখে মার্কিন কর্মকর্তারা আরও হতাশ হন। রুবিও স্পষ্ট বলেন—“আমরা কেবল বৈঠকের জন্য বৈঠক করতে পারি না।” অন্যদিকে লাভরভ পাল্টা মন্তব্য করেন—মস্কো আলোচনা করতে আগ্রহী, তবে আলোচনা হতে হবে আলাস্কা শীর্ষ সম্মেলনের ‘সুস্পষ্ট ভিত্তি’র ওপর।
এই অবস্থায় কিয়েভ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকরা ট্রাম্পের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখতে দ্বিগুণ চেষ্টা চালায়। তাদের লক্ষ্য ছিল সময় কেনা, যাতে ট্রাম্প বুঝতে পারেন পুতিন আলোচনায় সৎ নয়। একজন ইউরোপীয় কূটনীতিক বলেন, “আমাদের শুধু সময় কিনতে হতো—এবং আমরা পেরেছি।”
এদিকে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে ব্লেম দিয়ে বলে, ইউরোপীয়রা ঘুমোচ্ছে না; তারা ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। তবে ইউক্রেন ও ইউরোপের জন্য এটা কৌশলগতভাবে জরুরি ছিল। কারণ ট্রাম্প পুতিনের সঙ্গে সরাসরি সমঝোতা করলে ইউক্রেনের নিরাপত্তা ও ইউরোপের সামগ্রিক কৌশলগত স্থিতি বিপন্ন হতো।
ট্রাম্প প্রশাসন অবশেষে কঠোর অবস্থানে যায়। অক্টোবর মাসে রাশিয়ার বড় দুটি তেল কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, যা ছিল তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম বড় নিষেধাজ্ঞা। মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট বলেন, “আমরা যা করছি সবই পুতিনকে আলোচনার টেবিলে আনতে।” কিন্তু পুতিন পাল্টা জবাবে বলেন, নিষেধাজ্ঞা ক্ষতিকর হলেও রাশিয়া নীতি বদলাবে না। কিছুদিন পরই রাশিয়া নতুন পারমাণবিক সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায়—যা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে ক্রেমলিন আপাতত শক্তির প্রদর্শনের পথেই এগোতে চাইছে।
ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে জটিল এই ভূরাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণ বহুস্তরীয়। ট্রাম্প ভেবেছিলেন ব্যক্তিগত কূটনীতি ও ‘ডিলমেকিং’ রাজনৈতিক কৌশল এখানে কার্যকর হবে। কিন্তু ইউক্রেন সংকট সামষ্টিক নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব ও ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রশ্ন—যা কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা অর্থনৈতিক প্রলোভন দিয়ে মীমাংসা করা যায় না।
পুতিন কেবল যুদ্ধবিরতি নয়, বরং ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তার ওপর নিয়ন্ত্রণ চান। কিয়েভ চায় রাশিয়ার হুমকি থেকে দীর্ঘমেয়াদে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা। আর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ চায়—যুদ্ধ শেষ হলেও তা যেন অঞ্চলের নিরাপত্তাকে দুর্বল না করে। এই ভিন্ন ভিন্ন নিরাপত্তা বাস্তবতা—তিন পক্ষকেই অচলাবস্থার মধ্যে আটকে রেখেছে।
সবশেষে বলা যায়, পরিস্থিতি অনেকটা শীতল যুদ্ধ–পরবর্তী যুগের সবচেয়ে জটিল মুহূর্তগুলোর একটি। ট্রাম্প–পুতিন যোগাযোগ চলছে ঠিকই, কিন্তু তার অনুবাদ ঘটছে না বাস্তব অগ্রগতিতে। বরং পারস্পরিক অবিশ্বাস, শক্তি প্রদর্শন, এবং রাজনৈতিক লক্ষ্যস্থিরতার সংঘাতে উভয়পক্ষই আরও কঠোর অবস্থানের দিকে এগোচ্ছে। যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ক্ষমতায় এলেও ট্রাম্প তা করতে পারছেন না—কারণ সমস্যাটি কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা রাজনৈতিক চুক্তির বিষয় নয়, বরং গভীর ভূরাজনৈতিক স্বার্থ ও নিরাপত্তা সমীকরণের টানাপোড়েন।
আপনার মতামত জানানঃ