আলাস্কার আকাশে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের করমর্দনের দৃশ্য ছড়িয়ে পড়ে, তখন অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে—এটি কি কেবল কূটনৈতিক সৌজন্য, নাকি এর ভেতরে লুকিয়ে আছে ভূরাজনৈতিক নতুন সমীকরণ? লালগালিচায় অভ্যর্থনা, সৌজন্যমূলক বক্তব্য এবং দীর্ঘ বৈঠকের প্রতিশ্রুতির মধ্যেও দেখা গেছে ক্ষমতার রাজনীতি, ব্যক্তিগত মনস্তত্ত্ব এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিলতার ছাপ।
এই বৈঠককে অনেক বিশ্লেষক কেবল এক সাধারণ রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে দেখেননি। বরং তারা মনে করেন, পুতিন এখানে ব্যবহার করেছেন তাঁর গুপ্তচরজীবনের অভিজ্ঞতা—কীভাবে প্রশংসা, মনস্তাত্ত্বিক চাপ এবং প্রতীকী ইঙ্গিতের মাধ্যমে একজন আত্মপ্রেমী নেতাকে প্রভাবিত করা যায়। কিয়েভভিত্তিক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পুতিন ট্রাম্পকে প্রশংসার মাধ্যমে এমনভাবে আবদ্ধ করেছেন, যাতে বৈঠক শেষে ট্রাম্প বারবার বলেছেন, “চূড়ান্ত চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত কোনো চুক্তি নেই।” যদিও এই বক্তব্যে এক ধরনের দৃঢ়তা শোনা যায়, তবুও অনেকেই মনে করছেন এটি মূলত রুশ প্রেসিডেন্টের কথার প্রতিধ্বনি।
প্রথম মুহূর্তেই পুতিনের কৌশল স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রানওয়েতে দাঁড়িয়ে তিনি ট্রাম্পকে বলেন, “শুভ সকাল, প্রিয় প্রতিবেশী।” শব্দের মধ্যে মিশে ছিল এক ধরনের কূটনৈতিক ইঙ্গিত—আলাস্কার ভৌগোলিক অবস্থান, রাশিয়ার নিকটবর্তীতা এবং ইতিহাসের টানাপোড়েন। এরপর ট্রাম্প যখন তাঁকে প্রেসিডেন্টের গাড়িতে বসান, সেটিও কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং তা ছিল এক ধরনের বৈধতা প্রদান। পুতিনকে সমান মর্যাদা দিয়ে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প একবারে পরিষ্কার করে দেন, তিনি রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন বার্তা দিতে চান।
বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে দেখা গেছে আরেকটি কৌশল। পুতিন দীর্ঘ আট মিনিট ধরে বক্তৃতা দেন, যেখানে ট্রাম্প মাত্র তিন মিনিট কথা বলেন। পুতিন তাঁর বক্তৃতায় বারবার উল্লেখ করেন, ট্রাম্পই বলেছেন ২০২০ সালে তিনি জিতলে ইউক্রেন যুদ্ধ হতো না। এমন মন্তব্যকে পুনরাবৃত্তি করে পুতিন যেন বোঝাতে চাইছিলেন, তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের বক্তব্যকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন। একই সঙ্গে ট্রাম্পকে এমনভাবে তুলে ধরছেন, যেন তিনি বিশ্বশান্তির একমাত্র সম্ভাব্য রক্ষক।
তবে সব বিশ্লেষকই একমত নন যে বৈঠকটি পুরোপুরি পুতিনের সাফল্য। ইউক্রেনীয় পর্যবেক্ষক ইগার টাইশকেভিচ মনে করেন, রাশিয়া কেবল প্রশংসা নয়, অর্থনীতি ও ভূরাজনৈতিক তাসও খেলছে। তাঁদের মতে, মস্কো ওয়াশিংটনকে প্রলুব্ধ করছে চীনকে নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে। অর্থাৎ ট্রাম্প যদি রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করেন, তবে হয়তো চীনকে একা মোকাবিলা করা সহজ হবে। এই কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য স্বল্পমেয়াদে লাভজনক মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা রাশিয়ার জন্য রাজনৈতিক সুবিধা বয়ে আনবে।
আরেক বিশ্লেষক বলেন, ইউক্রেন এই পুরো খেলায় মূল চরিত্র নয়, বরং পার্শ্বচরিত্র। গুরুত্বপূর্ণ হলেও তারা আলোচনায় কেন্দ্রীয় অবস্থানে ছিল না। ট্রাম্প–পুতিন বৈঠক যুদ্ধ থামানোর কোনো নতুন পথ দেখায়নি। বরং বৈঠকটি হয়ে উঠেছে বৃহৎ শক্তিগুলোর পারস্পরিক স্বার্থের দরকষাকষির এক অঙ্গন। এ কারণেই ওয়াশিংটন ও বেইজিং—দুজনেই রাশিয়াকে তৃতীয় বিশ্বশক্তির মর্যাদা দিতে নারাজ।
তবে ইউক্রেনের সামরিক মহল বৈঠকের ফলাফল নিয়ে হতাশ। সাবেক উপপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইহর রোমানেনকো মনে করেন, ট্রাম্প পুতিনকে আন্তর্জাতিক বৈধতা দিয়েছেন, যা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁর মতে, পুতিন একজন একঘরে রাজনীতিক ছিলেন, যাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি করা উচিত। অথচ আলাস্কায় ট্রাম্পের সঙ্গে সরাসরি বৈঠকের মাধ্যমে সেই অবস্থান ভেঙে গেছে।
ইউক্রেনীয় পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, এখন যুদ্ধ আরও তীব্র হতে পারে। রাশিয়া ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বাড়াতে পারে, এবং আরও বেশি সংখ্যক নাগরিককে যুদ্ধে টেনে নিতে পারে। একই সঙ্গে অর্থনীতিকে সামরিক চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। অর্থাৎ বৈঠক শান্তির সম্ভাবনা বাড়ায়নি, বরং নতুন অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে।
এখানে প্রশ্ন জাগে, ট্রাম্পের অবস্থান আসলে কী? তিনি বৈঠকে বললেন, “অনেক বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি, কিছু বড় বিষয়ে নয়। তবে কিছু অগ্রগতি হয়েছে।” তাঁর এই বক্তব্য শোনায় কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা, কিন্তু বিশ্লেষকদের চোখে এটি অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থক। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট অবস্থান তিনি নেননি। নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে প্রতিশ্রুতি দেননি। ফলে বাস্তবে এই বৈঠক থেকে ইউক্রেন কোনো সুনির্দিষ্ট লাভ পায়নি।
ভবিষ্যতের চিত্র আরও জটিল। যদি যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে চীনকে নিয়ন্ত্রণের পথে হাঁটে, তবে ভূরাজনৈতিক সমীকরণে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। ওয়াশিংটন হয়তো মনে করছে, মস্কোকে পুরোপুরি পরাজিত করার দরকার নেই, বরং তাকে আংশিক সহযোগী বানানোই কৌশলগতভাবে লাভজনক। অন্যদিকে পুতিন সেটিকে নিজের রাজনৈতিক পুনর্বাসন হিসেবে ব্যবহার করছেন।
বৈঠকের অন্তরালে চীনের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। বেইজিং চায় না রাশিয়া–যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অতিরিক্ত উষ্ণ হোক, কারণ এতে তাদের ভূরাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হতে পারে। একই সময়ে ওয়াশিংটনও চায় না রাশিয়া ও চীনের স্বার্থ এক হয়ে যাক। এই টানাপোড়েনের ভেতরেই দাঁড়িয়ে আছে ইউক্রেন—একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, যার ভাগ্য নির্ধারণ হচ্ছে বৃহৎ শক্তিগুলোর বোর্ডরুমে।
আলাস্কার বৈঠক তাই হয়ে উঠেছে এক প্রতীকী ঘটনা। বাহ্যত সৌহার্দ্যপূর্ণ করমর্দন ও হাস্যোজ্জ্বল ছবি থাকলেও ভেতরে জমা আছে অবিশ্বাস, প্রভাব বিস্তার ও কৌশলগত দরকষাকষি। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্ন নিতে চাননি ট্রাম্প ও পুতিন কেউই। যেন ইচ্ছাকৃতভাবে অজানা রেখেছেন তাদের কথোপকথনের মূল সুর। এতে বোঝা যায়, আলোচনার বড় অংশ প্রকাশ হয়নি, হয়তো তা আরও সংবেদনশীল।
অবশেষে, এই বৈঠক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তির সোপান গড়ল কি না তা এখনো অনিশ্চিত। অনেকের চোখে এটি কেবল পুতিনের পুনরুত্থান, আবার কারও মতে এটি ট্রাম্পের কূটনৈতিক জটিলতার প্রকাশ। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট—ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে যে ধরনের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন, তা আলাস্কার আকাশে দেখা যায়নি। বরং দেখা গেছে দুই নেতা নিজেদের স্বার্থে একে অপরকে ব্যবহার করার খেলা।
বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে এ বৈঠক হয়তো স্মরণীয় হয়ে থাকবে সেই কারণেই যে, এখানে স্পষ্টভাবে বোঝা গেছে প্রশংসা, প্রতীক ও ব্যক্তিগত কৌশলও কখনো কখনো যুদ্ধক্ষেত্রের কামানের মতোই প্রভাব বিস্তার করতে পারে। আর এই প্রভাবের ছায়াতেই আগামী দিনে গড়ে উঠতে পারে নতুন এক বিশ্বব্যবস্থা, যেখানে শান্তির সংজ্ঞা হবে কেবল শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর দরকষাকষির সমানুপাতিক।
আপনার মতামত জানানঃ