
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প আবারও মধ্যপ্রাচ্যের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। হামাসকে উদ্দেশ্য করে তিনি এক কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন—৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিহত সব জিম্মির মৃতদেহ ফেরত দিতে হবে, নতুবা কঠিন পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে। ট্রাম্পের এই বার্তা প্রকাশ পায় তাঁর নিজস্ব সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যালে’ দেয়া এক পোস্টে। সেখানে তিনি বলেন, “কিছু মৃতদেহ হয়তো উদ্ধার করা কঠিন, কিন্তু অন্যগুলো তারা এখনই ফেরত দিতে পারে।” তাঁর দাবি, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি রক্ষার পুরো প্রক্রিয়া এখন এই সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।
ট্রাম্পের বক্তব্যে বোঝা যায়, তিনি এই সংকটকে শুধু মানবিক নয়, কূটনৈতিকভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, “দুই পক্ষের প্রতি ন্যায্য আচরণ কেবল তখনই সম্ভব, যখন উভয়েই নিজেদের দায়িত্ব পালন করবে।” তাঁর মতে, হামাস যদি এই নির্দেশ অমান্য করে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র এই পরিস্থিতিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে, এবং প্রয়োজনে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।
একই সঙ্গে ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, হামাস যদি তাঁর নির্দেশ না মানে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশ একযোগে ব্যবস্থা নিতে পারে। তিনি বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি রক্ষায় অনেক দেশই ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত। কেউই এই অঞ্চলে আবারও অস্থিরতা চায় না।” তাঁর বক্তব্যে বোঝা যায়, এই উদ্যোগ শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নয়, বরং বৃহত্তর আঞ্চলিক জোটের অংশ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
অন্যদিকে, ট্রাম্প আরও জানিয়েছেন যে যুদ্ধবিরতির পর গাজা অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে কাতার শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এটি বর্তমানে চলমান কূটনৈতিক প্রচেষ্টার একটি অংশ, যা মূলত যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যে নেওয়া হচ্ছে। ট্রাম্প এই প্রস্তাবকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন এবং কাতারের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন।
এদিকে, বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ট্রাম্প এশিয়া সফরের পথে আল উদেইদ বিমান ঘাঁটিতে যাত্রাবিরতি করেন। সেখানে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুর রহমান আল থানির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। এই ঘাঁটিতেই যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক সামরিক সদর দপ্তর অবস্থিত, যেখানে হাজারো মার্কিন সেনা অবস্থান করছে। ট্রাম্প কাতারি নেতাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “আপনারা গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিশ্চিত করতে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন। আমরা মধ্যপ্রাচ্যে এক অবিশ্বাস্য শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছি, আর তাতে কাতারের ভূমিকা বিশাল।”
তিনি আরও যোগ করেন, কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ‘বিশ্বের বন্ধু’ বলে মনে করেন। ট্রাম্পের এই প্রশংসা কূটনৈতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাতারই ছিল গাজা সংকট নিয়ে বহু আলোচনার মূল মধ্যস্থতাকারী।
এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওও। তিনি কাতারি নেতাদের সঙ্গে যৌথ আলোচনায় অংশ নেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। ট্রাম্প প্রশাসন এই সংকটে যে কঠোর অবস্থান নিচ্ছে, তা রুবিওর উপস্থিতিতেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
গোটা ঘটনাটি এখন শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা হামাস নয়, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি নতুন এক কূটনৈতিক বাস্তবতার সূচনা করেছে। একদিকে তিনি শক্ত অবস্থান নিচ্ছেন, অন্যদিকে কূটনৈতিক যোগাযোগও চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর বার্তায় যেমন কঠোরতা আছে, তেমনি আছে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার ইঙ্গিতও।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব পুনর্গঠনের চেষ্টা। দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে নানা দ্বন্দ্বের মধ্যেও ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে। ট্রাম্পের এই বক্তব্যে তাঁর পুরনো নীতি—“শক্তির মাধ্যমে শান্তি”—আবারও ফিরে এসেছে। তিনি যেন স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র নীরব দর্শক নয়।
হামাসের জন্য এই আলটিমেটাম নিঃসন্দেহে বড় চাপের কারণ। ৪৮ ঘণ্টার সময়সীমা পেরিয়ে গেলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়, তবে ট্রাম্পের ভাষা ইঙ্গিত দিচ্ছে—প্রয়োজনে সামরিক বা অর্থনৈতিক চাপও আসতে পারে।
অন্যদিকে, কাতারের ভূমিকা নতুন করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাচ্ছে। তারা যেমন হামাসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও কূটনৈতিক সম্পর্ক শক্ত করছে। যুদ্ধবিরতির পর গাজায় শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর ইচ্ছা তাদের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে অবস্থান আরও দৃঢ় করবে।
সব মিলিয়ে, ট্রাম্পের এই হুঁশিয়ারি শুধু হামাসের উদ্দেশ্যে নয়, বরং পুরো অঞ্চলের উদ্দেশ্যে এক রাজনৈতিক বার্তা—মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা এখন আর কেবল কূটনৈতিক আলোচনার বিষয় নয়, বরং দায়িত্ব ও সিদ্ধান্তের প্রশ্ন। ৪৮ ঘণ্টার এই সময়সীমা তাই এখন বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে দেখা হচ্ছে, যার ফলাফল নির্ধারণ করতে পারে ভবিষ্যতের মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও।
আপনার মতামত জানানঃ