
লুটপাট, অগ্নিসংযোগ আর সংঘবদ্ধ হামলার ঘটনাগুলো আমাদের সমাজে নতুন কিছু নয়। নতুন হলো এগুলোকে ন্যায্যতা দেওয়ার নির্লজ্জ ও ভয়ংকর বুদ্ধিবৃত্তিক চেষ্টা। মহিউদ্দিন আহমদের এই কলাম মূলত সেই জায়গাটিতেই আঘাত করে—যেখানে সহিংসতাকে ‘প্রেশার গ্রুপের কার্যক্রম’ বলে ধুয়ে-মুছে সাফ করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তিনি শুরুতেই ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা বলেন। মানুষ হিসেবে আমরা কেউই জানি না, কাল কী ঘটবে। কিন্তু অভিজ্ঞতা, কাণ্ডজ্ঞান আর ইতিহাস আমাদের কিছু আভাস দেয়। সমস্যা হলো, ব্যক্তিগত বোধ বা প্রস্তুতি তখনই অকার্যকর হয়ে পড়ে, যখন চারপাশের সমাজ ও প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিতভাবে দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ হয়।
যা আমরা চাই না, যা আমাদের প্রত্যাশার বাইরে—তাকেই আমরা অঘটন বলি। অঘটন ঘটলে আমরা অবাক হই, হতাশ হই, ভেঙে পড়ি। কিন্তু লেখক স্মরণ করিয়ে দেন, কোনো ঘটনাই শূন্য থেকে জন্ম নেয় না। সহিংসতা, হামলা, লুটপাট—এসব ঘটে কারণ কেউ তা ঘটাতে চায়। এর পেছনে থাকে পরিকল্পনা, উসকানি আর নির্দিষ্ট লক্ষ্য। সাম্প্রতিক সময়ে দুটি জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা ও দুটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের ওপর হামলা তারই উদাহরণ। এগুলো হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোনো দুর্ঘটনা নয়। অনেক দিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষোদ্গার চলছিল, প্রতিষ্ঠানগুলোকে শত্রু বানানো হচ্ছিল। কিন্তু যে মাত্রায় আক্রমণ হলো—লুটপাট, অগ্নিসংযোগ—তা অনেকের কল্পনার বাইরে ছিল।
এই হামলাগুলোকে লেখক ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর সঙ্গে তুলনা করেন—অর্থাৎ এমন এক পরিকল্পিত আঘাত, যা প্রতিপক্ষকে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দেয়। উদ্দেশ্য একটাই—ভয় দেখানো, হুঁশিয়ার করে দেওয়া। বার্তা পরিষ্কার: আমরা শক্তিশালী, আমরা চাইলে ধ্বংস করতে পারি। এখানেই আসে ‘মব জাস্টিস’ নামের বিভ্রান্তিকর ধারণা। একদল লোক নিজেদের হাতে আইন তুলে নেয়, মুহূর্তের মধ্যে বিচার করে, আর সেই বিচার কার্যকর করে ফেলে। এটাকে কেউ কেউ ‘ন্যায়বিচার’ বলে সাজাতে চায়। কিন্তু লেখকের প্রশ্ন—এটা আদৌ জাস্টিস, নাকি নগ্ন ভায়োলেন্স?
তিনি দেখান, মব ভায়োলেন্সের পেছনে কেবল আবেগ নয়, থাকে স্পষ্ট রাজনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্য। বিচারব্যবস্থা দুর্বল, ধীর আর ব্যয়বহুল—এই বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না। বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকে, ভুক্তভোগী সর্বস্বান্ত হয়। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই নিজের হাতে আইন তুলে নিতে উৎসাহিত হয়। কিন্তু লেখক সতর্ক করেন—আইনের শাসন কার্যকর না হলে এই সহিংসতা বন্ধ হবে না। সহজ, সস্তা ও দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে মব জাস্টিস নামের এই দানব সমাজকে গ্রাস করতেই থাকবে।
তবে বিচারব্যবস্থার ব্যর্থতা দিয়েই সব ব্যাখ্যা করা যায় না। লেখক আরও গভীরে যান। তিনি বলেন, আমাদের সমাজ এখনো গভীরভাবে পশ্চাৎপদ, এক ধরনের মধ্যযুগীয় ‘ট্রাইবাল’ মানসিকতায় আটকে আছে। এখানে মতাদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে গোত্র। প্রতিটি গোত্র নিজেকে একমাত্র সত্যের ধারক মনে করে, আর ভিন্নমতকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। সেই শত্রুকে শায়েস্তা করাই গোত্রপতির দায়িত্ব। গোত্রপতি এখানে কেবল নেতা নন, তিনি ‘ত্রাতা’। তাঁর নির্দেশই চূড়ান্ত। তিনি স্লোগান দেন—আগুন জ্বালো—আর অনুসারীরা আগুন হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এই মানসিকতার শিকড় রাজনীতিতে গভীর। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনো ‘চোখের বদলে চোখ, জানের বদলে জান’ ধারণায় আচ্ছন্ন। স্লোগানগুলোও তাই। “একটা-দুইটা ধর, ধরে ধরে জবাই কর”—এগুলো কোনো প্রান্তিক মানুষের ভাষা নয়, বরং শিক্ষিত সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আর রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে উচ্চারিত শব্দ। লেখক দেখান, কীভাবে সহিংসতার ভাষা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। বক্তৃতায় যত বেশি উত্তেজক শব্দ, যত বেশি হিংস্র হুংকার, তত বেশি হাততালি। জনপ্রিয়তা মাপা হয় আগ্রাসনের মাত্রায়।
এই আগ্রাসনের ঐতিহাসিক উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি মোগল সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের শাস্তির নির্মম পদ্ধতির কথা স্মরণ করেন। হাতির পায়ে পিষে মারা, জীবিত মানুষকে গাধার চামড়ায় মুড়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা—এসব ছিল ক্ষমতার প্রদর্শন, জনসমক্ষে ভয় তৈরি করার কৌশল। লেখকের ইঙ্গিত পরিষ্কার—আমাদের আজকের স্লোগান, ফাঁসির দাবি, প্রকাশ্যে শাস্তির উন্মাদনা সেই মধ্যযুগীয় নিষ্ঠুরতার আধুনিক রূপ।
সংবাদমাধ্যম ও সংস্কৃতির ওপর হামলার প্রসঙ্গে লেখক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন তোলেন। পত্রিকার পাঠক মূলত মধ্যবিত্ত। দেশের মোট ছাপা পত্রিকার সার্কুলেশন বড়জোর কয়েক লাখ। তবু বলা হচ্ছে, একটি জনপ্রিয় পত্রিকা ‘জনগণের শত্রু’। কোন জনগণ? যদি জনগণই শত্রু মনে করে, তাহলে সেই পত্রিকা এত পড়া হয় কেন? যারা হামলা চালায়, উসকানি দেয়—তাদের বড় অংশই পত্রিকা পড়ে না। অথচ তারাই ‘জনগণের প্রতিনিধি’ সেজে রায় দেয়।
এই হামলাগুলোর সঙ্গে যে আরেকটি গোষ্ঠী সব সময় যুক্ত হয়, তা হলো লুটেরা। লেখক স্পষ্টভাবে বলেন, একশ্রেণির লোক সব সময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। কোথায় হামলা হবে, কোথায় বিশৃঙ্খলা—এই অপেক্ষায়। সুযোগ পেলেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে, কম্পিউটার, চেয়ার-টেবিল, টাকাপয়সা লুট করে নেয়, শেষে আগুন ধরিয়ে দেয়। আদর্শ, ধর্ম, নৈতিকতা—এসব তাদের কাছে অজুহাত মাত্র।
সবচেয়ে ভয়ংকর জায়গাটি আসে তখন, যখন বুদ্ধিজীবী পরিচয়ের কিছু মানুষ এই লুটপাটকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তারা বলেন, এরা মব নয়, এরা ‘প্রেশার গ্রুপ’। যারা একে মব বলে, তারা নাকি স্বৈরাচারের দোসর। লেখক এই যুক্তিকে নগ্নভাবে উন্মোচন করেন। প্রশ্ন করেন—লুটপাটকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেয়ে ভয়ংকর আর কী হতে পারে? ভাষার এই কারসাজিই সহিংসতাকে স্বাভাবিক করে তোলে, অপরাধকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রূপ দেয়।
এই কলাম আসলে কোনো একক ঘটনার বিবরণ নয়। এটি একটি সমাজের মানসিক অবক্ষয়ের দলিল। যেখানে ভিন্নমত শত্রু, সমালোচনা অপরাধ, আর সহিংসতা হয়ে উঠছে গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক ভাষা। লেখকের উদ্বেগ গভীর, কারণ এই আগুন যদি এখনই না থামে, তবে তা কেবল সংবাদমাধ্যম বা সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। একদিন এই আগুন সবার ঘরেই পৌঁছাবে।
মহিউদ্দিন আহমদের লেখা পাঠককে আরাম দেয় না, বরং অস্বস্তিতে ফেলে। তিনি আয়না ধরেন—যেখানে আমরা নিজেদের মুখ দেখতে পাই। প্রশ্ন হলো, সেই মুখ দেখে আমরা কি চোখ ফিরিয়ে নেব, নাকি সত্যি সত্যি ভাবব, এই ভয়ংকর ন্যায্যতাগুলো আমাদের সমাজকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ