
মার্কিন রাজনীতিতে এক নাটকীয় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে সাম্প্রতিক দুটি দিন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দীর্ঘদিনের একচ্ছত্র প্রভাব যেন ভেঙে পড়েছে মুহূর্তেই। যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের অপ্রত্যাশিত জয় ও সুপ্রিম কোর্টে ট্রাম্পের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকে নড়বড়ে করে তুলেছে। ট্রাম্প যেভাবে নিজের ক্ষমতাকে অবারিত ও সর্বময় মনে করতেন, সেই বিশ্বাস এখন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি।
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ট্রাম্প আমেরিকার প্রশাসনিক, কূটনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে এক নতুন ঢেউ তুলেছিলেন। “আমেরিকা ফার্স্ট” স্লোগানে তিনি দেশকে একধরনের একাকিত্বে ঠেলে দেন। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করে, ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি করে, এমনকি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকেও চাপে রাখেন। তাঁর এই আক্রমণাত্মক নীতিতে দেশীয় রাজনীতিতেও বিভাজন বেড়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তহবিল বন্ধ, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, ও সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত ব্যবহার তাঁকে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। কিন্তু এখন সেই ক্ষমতার প্রদর্শনের জোয়ারে প্রথম ফাটল ধরেছে।
নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জোহরান মামদানির জয় ছিল এক প্রতীকী ঘটনা। এটি শুধু একটি শহরের রাজনীতি নয়, বরং ট্রাম্পের প্রভাবের বিরুদ্ধে জনমতের প্রতিবাদ। ভার্জিনিয়া ও নিউ জার্সিতেও ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের জয় দেখিয়েছে যে রিপাবলিকানদের প্রভাবশালী ঘাঁটিগুলোতেও ভোটাররা বদল চাইছেন। এই ফলাফল অনেকটা ট্রাম্পের প্রশাসনিক নীতির প্রতি নাগরিক অসন্তুষ্টির বহিঃপ্রকাশ। যেভাবে ট্রাম্প তাঁর বিরোধীদের আক্রমণ করতেন, গণমাধ্যমকে শত্রু ভাবতেন, এবং সরকারি দপ্তরগুলোতে নিজের অনুগতদের বসিয়ে প্রশাসন চালাতেন, তা অনেক আমেরিকানের কাছে কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের পরিচায়ক হয়ে দাঁড়ায়।
একইসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা ট্রাম্পের বাণিজ্যিক ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। প্রেসিডেন্টের জরুরি ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি যে ইচ্ছেমতো শুল্ক আরোপ করতে পারেন—এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে আদালত। এটি শুধু আইনি দৃষ্টিকোণেই নয়, বরং গণতান্ত্রিক ভারসাম্যের দিক থেকেও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে বহুদিন ধরেই অভিযোগ ছিল যে তিনি সংবিধানের চেতনাকে উপেক্ষা করে নির্বাহী ক্ষমতাকে সর্বোচ্চ স্থানে বসাতে চেয়েছেন। আদালতের এই হস্তক্ষেপ সেই একচ্ছত্রতাকে ভেঙে দেওয়ার ইঙ্গিত বহন করছে।
এদিকে ট্রাম্পের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা এখন আরও আত্মবিশ্বাসী। ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গাভিন নিউসম ও ইলিনয়ের গভর্নর জে বি প্রিটজকার ইতিমধ্যে প্রকাশ্যে ট্রাম্পের নীতির বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা স্পষ্ট করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র কোনো এক ব্যক্তির রাজ্য নয়; এটি একটি প্রতিষ্ঠানভিত্তিক গণতন্ত্র। নিউসম যেমন বলেছিলেন, “ভালুককে খোঁচা দিলে সে গর্জন করে।” এই রূপকটিই বাস্তবে পরিণত হয়েছে—দীর্ঘদিনের নিস্তব্ধ বিরোধীরা এখন সরব। আদালত, রাজ্য সরকার ও ভোটার—সব দিক থেকেই ট্রাম্পকে ঘিরে প্রতিরোধের সুর জোরালো হচ্ছে।
ডেমোক্র্যাটদের এই সাফল্য শুধু রাজনৈতিক জয় নয়, এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক পালাবদলও। যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা এখন একক নেতৃত্বের বিপদ সম্পর্কে সচেতন হচ্ছেন। সাম্প্রতিক জরিপগুলোতে দেখা গেছে, জনসাধারণ মনে করছেন ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে দেশ দিকভ্রান্ত, অর্থনীতি অনিশ্চিত, এবং সমাজ বিভক্ত। মধ্যবিত্ত শ্রেণি, বিশেষত শহুরে ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, তাঁর “সবকিছু আমি জানি” মনোভাবকে আর মেনে নিচ্ছে না। তাঁরা চাচ্ছেন দায়িত্বশীল, সহনশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ নেতৃত্ব, যা যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ট্রাম্পের “আমি রাজা নই, কিন্তু যা চাই তা করতে পারি” মনোভাব এখন তাঁর জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন ইতিহাসে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা অনেক বিস্তৃত হলেও, সেটি সবসময়ই নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ট্রাম্প সেই সীমা ভাঙতে চেয়েছিলেন। তিনি সুপ্রিম কোর্টে রক্ষণশীল বিচারকদের নিয়োগ দিয়ে একপ্রকার নিজস্ব দুর্গ তৈরি করেছিলেন। কিন্তু এখন সেই বিচারকরাই তাঁর ক্ষমতার প্রয়োগে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। এটি বোঝাচ্ছে যে মার্কিন রাষ্ট্রব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য এখনও কার্যকর।
আগামী বছরের মধ্যবর্তী নির্বাচনকে ঘিরে ট্রাম্পের জন্য চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে। ডেমোক্র্যাটদের সাম্প্রতিক সাফল্য তাঁদের সংগঠিত করেছে, আর রিপাবলিকান পার্টির অভ্যন্তরেও এখন মতভেদ বাড়ছে। অনেক প্রভাবশালী রিপাবলিকান নেতাই মনে করছেন ট্রাম্পের ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্ব এখন পার্টির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনমতের এই পরিবর্তন যদি অব্যাহত থাকে, তবে মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকানদের বড় ধাক্কা খাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
তবে ট্রাম্পের স্বভাব অনুযায়ী তিনি সহজে পিছু হটবেন না। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, তিনি সমালোচনার জবাব আগ্রাসীভাবে দেন। ইতিমধ্যেই তিনি নিউইয়র্কে কেন্দ্রীয় তহবিল কমানোর হুমকি দিয়েছেন, ক্যালিফোর্নিয়ায় হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়েছেন, এমনকি অঙ্গরাজ্যের মানচিত্র পুনর্নির্ধারণের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করছেন। এইসব পদক্ষেপ দেখায়—তিনি এখনও বিশ্বাস করেন যে ক্ষমতার লড়াইতে আগ্রাসনই তাঁর একমাত্র অস্ত্র।
তবে বাস্তবতা হলো, মার্কিন রাজনীতি এমন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে ট্রাম্পের সেই আগ্রাসনও ক্রমে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্রের স্বর এখন জোরালো, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনরুজ্জীবিত, আর ভোটাররা আরেকবার দায়িত্বশীল নেতৃত্বের প্রত্যাশায় মুখিয়ে আছেন। হয়তো এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক নতুন সূচনা—যেখানে ক্ষমতা নয়, নীতি, সংবিধান ও গণআস্থাই হবে নেতৃত্বের মাপকাঠি।
ট্রাম্পের রাজনৈতিক দর্শন ও শাসনধারার পতন এভাবেই ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে থেকে যাবে। কারণ এটি শুধু এক প্রেসিডেন্টের সীমাবদ্ধতা নয়, বরং গণতন্ত্রের আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়া। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ওপর জনগণের নিয়ন্ত্রণই আধুনিক গণতন্ত্রের মূল চেতনা, আর সেটিই আবার প্রমাণিত হলো এই দুই দিনে। যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে সেই চেতনার ধারাবাহিকতা রক্ষার ওপর—যেখানে কোনো ব্যক্তি নয়, প্রতিষ্ঠান ও জনগণই হবে চূড়ান্ত ক্ষমতার উৎস।
আপনার মতামত জানানঃ