
১৯৪৭ সাল। ভারত ও পাকিস্তান দুই রাষ্ট্রে বিভক্ত হচ্ছে উপমহাদেশ। সীমান্তের ওপারে মানুষ হঠাৎই ‘অপরজন’ হয়ে যায়। একদিকে রক্তাক্ত পাঞ্জাব, অন্যদিকে ছিন্নভিন্ন বাংলা—সবাই জানে এই দুই প্রদেশের গল্প। কিন্তু ইতিহাসের পাতার প্রান্তে থেকে গেছে জম্মুর নীরব চিৎকার। কাশ্মীর উপত্যকায় তখন তুলনামূলক শান্তি, কিন্তু জম্মুতে ততদিনে শুরু হয়েছে এক অপ্রকাশ্য যুদ্ধ—যেখানে মানুষের পরিচয়ই হয়ে উঠেছিল মৃত্যুদণ্ড।
তরুণ বেদ ভাসিন তখন আঠারো বছরের কিশোর। পরবর্তীতে কাশ্মীর টাইমস-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে তিনি লিখেছিলেন, “মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনা ঘোষণার পর থেকেই জম্মুতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। গুজব ছড়ানো হয় যে মুসলমানরা অস্ত্র তুলে নেবে, তারা হিন্দু ও শিখদের হত্যা করবে। বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। প্রশাসনের নেতৃত্বে মুসলমানদের নিরস্ত্র করা হয়, তাদের পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে থাকা সদস্যদের সরিয়ে দেওয়া হয়, যেন প্রতিরোধ করার শক্তি একটুও না থাকে।”
পুঞ্চ ও উধমপুর অঞ্চলে তখন মানুষের ক্ষোভ জমে উঠছে মহারাজা হরি সিংয়ের শাসনের বিরুদ্ধে। কর আদায়ের নতুন সিদ্ধান্তে গ্রামীণ মানুষ ক্ষুব্ধ, সেই ক্ষোভ দ্রুত রূপ নেয় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায়। প্রশাসন তখন সিদ্ধান্ত নেয়—যাদের আনুগত্য সন্দেহজনক, বিশেষত মুসলমানদের, তাদের নিষ্ক্রিয় করে দিতে হবে। শহরে কারফিউ জারি হয়, কিন্তু কারফিউয়ের আড়ালে চলতে থাকে নিধনযজ্ঞ। মুসলমানদের বলা হয়, “তোমাদের নিরাপত্তার জন্য তোমাদের পাকিস্তানে পাঠানো হবে।” শত শত পরিবারকে লরিতে বোঝাই করে পাঠানো হয় শিয়ালকোটের পথে—কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছায় না কেউ।
জম্মুর উপকণ্ঠে পৌঁছানোর পর লরিগুলো থামিয়ে দেওয়া হয়। আরএসএস সদস্য, শিখ উদ্বাস্তু ও স্থানীয় সশস্ত্র দল মিলে যাত্রীদের টেনে নামিয়ে হত্যা করে। নারীদের ওপর চালানো হয় যৌন সহিংসতা, শিশুদের হত্যা করা হয় পিতামাতার সামনেই। সৈন্যরা হয় অংশ নেয়, নয়তো নির্বিকার দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বেদ ভাসিন লিখেছেন, “লরির ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার আগে, ভিতরে মানুষের জীবন নিভে যাচ্ছিল। শহরের বাইরে বাতাসে মিশে ছিল রক্তের গন্ধ।”
এই হত্যাযজ্ঞের সংখ্যা আজও নিশ্চিত নয়। কিছু ইতিহাসবিদ বলেন ২০ হাজার, কেউ বলেন দুই লাখ ৩৭ হাজার। পাকিস্তানের শিয়ালকোটে পালিয়ে যাওয়া বেঁচে থাকা মানুষদের বয়ান থেকেই জানা যায় এই ভয়াবহ সত্য। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেকর্ডেও উল্লেখ আছে—মহারাজা হরি সিংয়ের নেতৃত্বে পরিকল্পিতভাবে দুই লাখেরও বেশি মুসলমান হয় হত্যা করা হয়েছিল, নয়তো দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। সাংবাদিক ইয়ান স্টিফেন্স তার বই Pakistan–এ লিখেছেন, “আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ সপ্তাহে পূর্ব পাঞ্জাব, পাতিয়ালা ও কাপুরথালায় যেমন পরিকল্পিত গণহত্যা হয়েছিল, জম্মুতেও সেই একই রক্তের ছাপ।”
১৯৪১ সালে জম্মু প্রদেশের মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২০ লাখ, তার মধ্যে মুসলমান ছিল ১২ লাখেরও বেশি। রাজধানী জম্মু শহরে ৫০ হাজার মানুষের মধ্যে ১৬ হাজার ছিল মুসলমান। কিন্তু ১৯৬১ সালের জনগণনায় দেখা যায়, মুসলমানদের সংখ্যা কমে এসেছে ভয়াবহভাবে—মাত্র ১০ শতাংশ। ইতিহাসবিদরা একে বলেন “Demographic Engineering”—জনগণসংখ্যা বদলে দিয়ে রাজনৈতিক ভারসাম্য তৈরি করা।
বেদ ভাসিন লিখেছিলেন, “শহরের হিন্দু এলাকাগুলোতে সেনারা অবস্থান নেয়, এবং সেখান থেকেই মুসলমানদের ওপর গুলি চালানো হয়। প্রশাসন তখন নীরব দর্শক নয়, বরং সক্রিয় সহযোগী।” RSS এবং শিখ উদ্বাস্তুরা হাতে তলোয়ার নিয়ে রাস্তায় ঘুরছিল, আর রাষ্ট্র তাদের ‘রক্ষক’ বলে প্রশ্রয় দিচ্ছিল। উধমপুর, ভাদেরওয়াহ, কাঠুয়া—প্রতিটি জেলা রক্তে ভেসে গিয়েছিল।
ব্রিটিশ কূটনীতিক সি.বি. ডিউক অক্টোবর ১৯৪৭ সালে জম্মু পরিদর্শনে গিয়ে রিপোর্টে লেখেন—“আমি দেখেছি পুড়ে যাওয়া গ্রাম, মৃতদেহে ভরা রাস্তা, আর একটি প্রশাসন যা মৃতদেহের দিকে তাকিয়েও কিছুই দেখে না।” মহাত্মা গান্ধীও জম্মুর পরিস্থিতি নিয়ে বলেছিলেন, “জম্মুর হিন্দু, শিখ এবং মহারাজা—এই তিন পক্ষই মুসলমানদের হত্যার দায় এড়াতে পারে না।”
এদিকে ডোগরা প্রশাসন ঘটনাটিকে চেপে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। নথি পুড়িয়ে ফেলা হয়, সংবাদমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। গবেষক ইদ্রিস কান্টের মতে, “এই গণহত্যার সত্য গোপন করা ছিল রাজ্যকে ‘হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ’ করার অংশ।” ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরু ও কাশ্মীরি নেতা শেখ আবদুল্লাহকেও তখন এই হত্যাযজ্ঞের খবর জানানো হয়, কিন্তু তারা নীরব ছিলেন—সম্ভবত রাজনৈতিক হিসাবেই।
এই রক্তাক্ত বাস্তবতার পরপরই পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে উপজাতি বাহিনী কাশ্মীর আক্রমণ করে। মহারাজা তখন দিল্লির সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির চুক্তি স্বাক্ষর করেন এবং ভারতীয় সেনা কাশ্মীরে প্রবেশ করে। শুরু হয় প্রথম ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ। জম্মুর সেই গণহত্যা শুধু একটি মানবিক বিপর্যয় ছিল না—এটাই ছিল কাশ্মীর সংকটের প্রথম অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।
আজও জম্মু ও কাশ্মীরের দুই প্রান্তের মানুষ ৬ই নভেম্বর পালন করে “জম্মু হত্যাকাণ্ড দিবস”। কেউ মোমবাতি জ্বালায়, কেউ শুধু চুপ করে থাকে। কিন্তু ভারতের মূলধারার ইতিহাসে এই অধ্যায় নেই পাঠ্যবইয়ে, নেই স্মৃতিস্তম্ভে। কেবল নদীর ধার, পাহাড়ের ছায়া আর বাতাসে ভেসে থাকা এক অব্যক্ত গন্ধ মনে করিয়ে দেয়—১৯৪৭ সালের জম্মু কেবল একটি শহর নয়, এটি এক অনুচ্চারিত কবরস্থান, যেখানে ইতিহাসের নীরবতা সবচেয়ে জোরে চিৎকার করে।
আপনার মতামত জানানঃ