বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থি দলগুলোর অবস্থান সবসময়ই একধরনের বিতর্ক ও কৌতূহলের জন্ম দেয়। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী—যে দলটি মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে দেশের রাজনীতিতে একটি প্রভাবশালী হলেও বিতর্কিত ভূমিকা রেখে এসেছে—তাদের প্রতিটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই বিশ্লেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সম্প্রতি দলটি নির্বাচনী জোট না করে “আসনভিত্তিক সমঝোতা”র পথে হাঁটার ঘোষণা দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপিসহ সমমনাদের নিয়ে একটি নতুন জোট গঠনের যে প্রচেষ্টা তারা চালিয়ে যাচ্ছিল, সেটি থেকে হঠাৎ সরে এসে এভাবে সমঝোতার কথা বলায় রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এটি কি কেবল বাস্তবতার চাপ, না কি এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোনো গোপন কৌশল?
জামায়াতের রাজনৈতিক কৌশলগত ইতিহাস বলছে, দলটি সবসময়ই বাস্তবতার সঙ্গে আপস করে রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারণ করে। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে অংশ নিয়ে ক্ষমতার অংশীদার হয়েছিল দলটি, এমনকি মন্ত্রীসভাতেও জায়গা পেয়েছিল দুইজন শীর্ষ নেতা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই রাজনৈতিক সম্পর্ক ভেঙে যায়। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে জোট ভেঙে দেয়, ফলে জামায়াত একপ্রকার একা পড়ে যায়। এরপর থেকে দলটি নতুন রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারণে নানা উদ্যোগ নেয়। ধর্মভিত্তিক অন্যান্য দল, যেমন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিসসহ আরও কয়েকটি ছোট দলকে নিয়ে তারা একটি নতুন ইসলামপন্থি জোট গঠনের পরিকল্পনা করে। সেই প্রচেষ্টাও বেশ দূর পর্যন্ত গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ঘোষণা দিয়েছে—জোট নয়, হবে কেবল আসনভিত্তিক সমঝোতা।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের ভাষায়, তারা কোনো সাংগঠনিক কাঠামোয় বাঁধা জোট চান না। বরং সমমনাদের সঙ্গে বসে নিশ্চিত করবেন যেন একই আসনে একাধিক প্রার্থী না থাকে। অর্থাৎ, এক ধরনের অনানুষ্ঠানিক নির্বাচনী সমঝোতা, যাতে ভোট বিভাজনের ঝুঁকি কমে আসে। খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদেরও বলেছেন, তাদের মূল চিন্তাই ছিল ভোট ভাগাভাগি রোধ করা—যাতে ইসলামপন্থি ভোট এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, জোটের তুলনায় এই পদ্ধতিতে দলগুলো বেশি স্বাধীনতা পায়, আবার নির্বাচনের পর জোটভিত্তিক দায়ও বহন করতে হয় না।
কিন্তু এই সিদ্ধান্তের পেছনে রাজনৈতিক বাস্তবতারও বড় ভূমিকা রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে যখন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, তখনই জামায়াত তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা শুরু করে। ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে তারা চেয়েছিল একটি বৃহত্তর ঐক্য গঠন করতে। চরমোনাই পীর ও জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের সৌজন্য সাক্ষাৎ সেই প্রক্রিয়ারই অংশ ছিল। কিন্তু সেই ঐক্য প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক রূপ না নেওয়ায় দলটি এখন বিকল্প পথে হাঁটছে। বাস্তবে এটি এমন এক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন, যেখানে আনুষ্ঠানিক জোট করলে নেতৃত্ব, প্রার্থী বাছাই, এমনকি নির্বাচনের পর ক্ষমতা বণ্টন নিয়েও জটিলতা দেখা দিতে পারে। আর এসব এড়াতেই “আসন সমঝোতা”র কৌশল গ্রহণ করেছে তারা।
বিশ্লেষক সালাহউদ্দিন মুহাম্মদ বাবরের মতে, ইসলামপন্থি দলগুলো এখন জোটের চেয়ে আসন সমঝোতাকে বেছে নিচ্ছে মূলত বাস্তব কৌশল হিসেবে। জোট করলে নির্বাচনের পরও নানা বিষয়ে সমঝোতা বজায় রাখতে হয়, যা অনেক সময় রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করে। কিন্তু আসনভিত্তিক সমঝোতা একদিকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করে, অন্যদিকে প্রত্যেক দলকে নিজস্ব অবস্থান বজায় রাখার সুযোগ দেয়। এই প্রক্রিয়ায় জামায়াতের লক্ষ্য হলো, যত বেশি দল নির্বাচনে অংশ নেয়, তত বেশি নির্বাচনটি “অংশগ্রহণমূলক” হিসেবে বিবেচিত হবে—যা সরকারের কাছেও গ্রহণযোগ্যতার ছাপ ফেলতে পারে।
অন্যদিকে, জামায়াতের এই কৌশলের আরেকটি দিক হলো—তাদের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক টিকে থাকার প্রয়াস। দলটি এখনো নিবন্ধনহীন, নির্বাচনে নিজস্ব প্রতীক ব্যবহার করতে পারছে না। ফলে তারা বিএনপি বা সমমনাদের প্রতীকে প্রার্থী দাঁড় করাতে বাধ্য হচ্ছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জামায়াতের ২২ জন প্রার্থী ধানের শীষ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এবারও তারা একই পথে হাঁটছে, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির সঙ্গে জোট নেই। সমমনাদের জন্য কিছু আসন ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টিও বিএনপির কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই বাস্তবতাই জামায়াতকে “ঘরোয়া সমঝোতা”র পথে নিয়ে গেছে।
দলের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও এই সিদ্ধান্তে ভূমিকা রেখেছে। একদিকে দলটি সরকারবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হিসেবে অবস্থান বজায় রাখতে চায়, অন্যদিকে জোটে গিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা হারাতে চায় না। ২০২৪ সালের অগাস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইসলামপন্থি রাজনীতির নতুন ধারা তৈরির যে আলোচনা শুরু হয়েছিল, সেখানে জামায়াত কেন্দ্রীয় ভূমিকা নিতে চেয়েছিল। কিন্তু অন্যান্য দল তাদের নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি হয়নি। ফলে আপসের পথ হিসেবে এই “আসন সমঝোতা”র মডেলই বাস্তবসম্মত মনে হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে জামায়াতের পদক্ষেপকে অনেক বিশ্লেষক “গোপন কৌশল” হিসেবে দেখলেও দলটি তা অস্বীকার করছে। তাদের বক্তব্য—এটি নিছক বাস্তবতা-ভিত্তিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যাতে বিরোধী শিবিরের ভেতর বিভাজন না হয়। তবে এই পদ্ধতি যদি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হয়, তাহলে ইসলামপন্থি রাজনীতির ভেতর একটি নতুন ধারা তৈরি হতে পারে। কারণ, এতে দলগুলোর পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা কমে আসবে, আর একযোগে তাদের ভোটব্যাংকও শক্তিশালী হবে।
সবশেষে বলা যায়, জামায়াতের এই নতুন কৌশল বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে। জোটবদ্ধ রাজনীতি থেকে সরে এসে “সমঝোতা ভিত্তিক” রাজনীতিতে তারা প্রবেশ করছে—যা হয়তো ভবিষ্যতে ইসলামপন্থি রাজনৈতিক বলয়কে নতুনভাবে সাজাবে। তবে এই কৌশল কতটা সফল হবে, তা নির্ভর করছে সমমনাদের পারস্পরিক আস্থা ও মাঠের বাস্তবতার ওপর। কারণ, বাংলাদেশে রাজনীতি যতটা নীতিনির্ভর, তার চেয়ে অনেক বেশি নির্ভর করে প্রেক্ষাপট, ব্যক্তিত্ব ও ক্ষমতার ভারসাম্যের ওপর। সেই ভারসাম্যের খেলাতেই জামায়াতের এই কৌশল একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
আপনার মতামত জানানঃ