একটি দেশ কতটা আত্মনির্ভরশীল, কতটা স্থিতিশীল—তার আসল পরীক্ষা কখনো মুদ্রা বা সামরিক শক্তিতে নয়, বরং একটিমাত্র ট্রাকে লুকিয়ে থাকে। হ্যাঁ, একটি ট্রাক। যে ট্রাকটি প্রতিদিন নিজ ভূখণ্ডে নির্বিঘ্নে চলতে পারে, সীমান্তে সংঘাত হোক বা রাজনীতিতে টানাপোড়েন। ভারত এখন সেই সহজ অথচ কঠিন পরীক্ষায় বারবার হোঁচট খাচ্ছে। মণিপুরে ২০২৩ সালের সহিংসতা এবং ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে নয়াদিল্লির ঘোষণা—যেখানে ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে ‘ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম’ বাতিল ও ১৬৪৩ কিলোমিটার সীমান্তে বেড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—এই দুই ঘটনাই ভারতের দুর্বলতার আয়না হয়ে দাঁড়িয়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিজস্ব পথ রক্তাক্ত ও অচল হয়ে পড়েছে। তাই আজ ভারতের ট্রাকগুলো নিঃশব্দে ঘুরপথে চলছে—বাংলাদেশের বন্দর ও মহাসড়ক ধরে, এক নিরাপদ, স্থিতিশীল প্রতিবেশীর কাঁধে ভর করে।
এই পথ কেবল একটি অর্থনৈতিক সুবিধা নয়; এটি এক গভীর ভূরাজনৈতিক স্বীকারোক্তি। ভারত তার পূর্বমুখী যাত্রায় এখন দুইটি দরজা ব্যবহার করতে পারে। একটি দরজা—বাহ্যিক, কূটনৈতিক, স্থিতিশীল—বাংলাদেশের মাধ্যমে। যেখানে মালবাহী কনটেইনার আসে চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দরে, পেরিয়ে যায় ঢাকা-কমিল্লা বা যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক, তারপর ত্রিপুরা, মেঘালয়, অসমে প্রবেশ করে কোনো জাতিগত চেকপয়েন্ট ছাড়াই। অন্য দরজাটি—অভ্যন্তরীণ ও কৌশলগত—মণিপুর হয়ে মিয়ানমারের দিকে: ইম্ফল-মোরে-তামু-মান্দালয়ে সংযোগ। এটি ছিল ভারতের বহু কাঙ্ক্ষিত ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির প্রতীক, আসিয়ান ও জাপানের কাছে প্রদর্শিত উন্নয়ন করিডর। কিন্তু এখন সেটি ধুলায় ঢাকা, ভগ্ন ও অবিশ্বাসে ভরা। এক দরজা বিদেশি হলেও শান্ত, অন্যটি নিজের হলেও রক্তাক্ত। তাই ভারত এখন শান্ত, বিদেশি দরজাটিই বেছে নিচ্ছে—বাংলাদেশের দরজা।
বাংলাদেশের কাছে এটি শুধু একটি আঞ্চলিক সড়ক নয়; এটি এক বিরল কূটনৈতিক সুবিধা। ভারতকে এখন বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তার নিজস্ব রাজ্যে পৌঁছাতে। এটি আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের এক নতুন কৌশলগত অবস্থান তৈরি করেছে—একটি দেশ, যার স্থিতিশীলতা এখন উপমহাদেশের অর্থনৈতিক প্রবাহের নির্ভরতা। ভারতের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার আজ বাস্তবতা, কিন্তু তার পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি নীতি—‘সংযোগ মানেই সমৃদ্ধি’। ভারত এই সংযোগ থেকে অর্থনৈতিক লাভ পায়, কিন্তু বাংলাদেশও এতে পায় আঞ্চলিক প্রভাব, ট্রানজিট ফি, অবকাঠামো উন্নয়ন, এবং কূটনৈতিক মর্যাদা। এ এক নীরব শক্তির প্রকাশ—যেখানে ঢাকার স্থিতিশীলতা দিল্লির অনিশ্চয়তার ভার বহন করছে।
কেন মণিপুর এই ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে সংকীর্ণ হয়ে গেল, তার উত্তর লুকিয়ে আছে বিশ্বাসের ভাঙনে। ২০২৩ সালের মে মাসে মণিপুরে যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল, তা শুধু ঘরবাড়ি পুড়ায়নি; পুড়িয়েছে সামাজিক আস্থা। উপত্যকা ও পাহাড়ের মানুষের সম্পর্ক ভেঙে গেছে। এমন এক রাজ্যে কোনো করিডর স্থায়ী হতে পারে না, যেখানে প্রতিটি ট্রাক চালককে ভাবতে হয়—“আমি এখন কার এলাকায় ঢুকছি?” সীমান্তে বন্দুকের আওয়াজ থাকলে বাণিজ্য থেমে যায়, আর থেমে গেলে থেমে যায় রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা। ২০২৪ সালে ভারত যখন নিরাপত্তার নামে পুরো সীমান্তে বেড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, তখন সেটি একদিকে অবৈধ চলাচল ও বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ, অন্যদিকে ছিল নিজেদের ভবিষ্যতের উপর এক অঘোষিত অবরোধ।
এই সিদ্ধান্তের ফল হলো—‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি, যা একসময় উত্তর-পূর্ব ভারতের আত্মবিশ্বাসের প্রতীক ছিল, সেটিই এখন এক পরিত্যক্ত ধারণা। নাগা, কুকি, মিজো জনগোষ্ঠীর সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো, যেগুলোর ওপর ভারত-মিয়ানমার সংযোগ দাঁড়িয়েছিল, তা ভেঙে পড়েছে। ভারতের নীতি নিরাপত্তা বাড়ালেও যোগাযোগ কমিয়েছে। ফলত, যে অঞ্চলকে ভারত একসময় পূর্বমুখী অর্থনীতির সেতু হিসেবে দেখেছিল, আজ সেটি নিজেই পরিণত হয়েছে বাধার প্রতীকে।
বাংলাদেশ, এর বিপরীতে, ভারতের জন্য উন্মুক্ত ও স্থিতিশীল এক প্রবেশপথ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সড়কে কোনো জাতিগত চেকপয়েন্ট নেই, কোনো গেরিলা হুমকি নেই, কোনো প্রশাসনিক দ্বিধা নেই। ঢাকা চুক্তি করে, বাস্তবায়নও করে। এই বাস্তবতা ভারতের কাছে এক স্বস্তির নিঃশ্বাস। প্রতিটি ভারতীয় কনটেইনার, যা বাংলাদেশের বন্দরে নামে, কেবল পণ্য বহন করে না—তা বহন করে দুই দেশের পারস্পরিক নির্ভরতার প্রমাণ।
কিন্তু বাংলাদেশের জন্য প্রশ্নটা এখানেই থেমে থাকে না। কারণ, ভারতের এই নির্ভরতা যেমন আমাদের সুযোগ দিচ্ছে, তেমনি দায়িত্বও বাড়াচ্ছে। একদিকে আমরা আঞ্চলিক অর্থনীতির সংযোগকেন্দ্র হয়ে উঠছি, অন্যদিকে এই ভূমিকা আমাদের রাজনীতিকে আরও সূক্ষ্ম ভারসাম্যের ওপর দাঁড় করাচ্ছে। আমাদের অবকাঠামো, বিশেষত চট্টগ্রাম-মংলা করিডর, এখন আন্তর্জাতিক স্বার্থের মঞ্চ। এখানে চীনও বিনিয়োগ করছে, জাপানও আগ্রহী, ভারতও সক্রিয়। এই জটিলতার মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি নীতি হয়ে উঠছে আঞ্চলিক কূটনীতির সূক্ষ্ম গণিত।
যে মুহূর্তে ভারত বাংলাদেশের পথ ব্যবহার করছে, সেই মুহূর্তেই তার নিজের ভেতরের একটি অঞ্চল—মণিপুর—অর্থনৈতিকভাবে আরও একঘরে হয়ে পড়ছে। প্রতিটি কনটেইনার, যা চট্টগ্রাম হয়ে আগরতলা পৌঁছায়, মণিপুরের চালককে কাজ থেকে বঞ্চিত করছে। অর্থাৎ ভারত নিজেই নিজের ভেতরে বৈষম্যের নতুন রেখা টানছে। বাংলাদেশের চোখে এটি এক অর্থনৈতিক সুযোগ হলেও, কৌশলগতভাবে এটি একটি সতর্ক সংকেতও বটে। কারণ, যখন কোনো বৃহৎ রাষ্ট্র নিজের অভ্যন্তরীণ অঞ্চলের ওপর আস্থা হারায়, তখন তার পররাষ্ট্রনীতিও হয়ে পড়ে অনিশ্চিত।
ভারত এখন এক ধরনের কৌশলগত দ্বিধায় আটকে আছে। চীন তার ইউনান-মিয়ানমার করিডর ধরে নির্মাণ করছে কিয়াউকফিউ বন্দর পর্যন্ত সংযোগ, যদিও মিয়ানমার গৃহযুদ্ধের আগুনে জ্বলছে। তবু বেইজিং পিছিয়ে যায়নি। তারা যুদ্ধের মধ্য দিয়েই ভবিষ্যৎ গড়ে। অন্যদিকে, দিল্লি এখন যেন কঠিন বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে পথ খুঁজছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজধানীগুলো—ব্যাংকক, জাকার্তা, টোকিও—এই পার্থক্য দেখছে। তাদের কাছে এটি এমন এক বার্তা যে, “চীন সংঘাতের মধ্য দিয়ে গড়ে তোলে, ভারত সংঘাত এড়িয়ে যায়।” এটি ভারতের উদীয়মান বিশ্বশক্তি হওয়ার ভাবমূর্তির সঙ্গে খাপ খায় না।
বাংলাদেশ থেকে এই দৃশ্য ভিন্ন এক পাঠ দেয়। দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার মানদণ্ড এখন আর সামরিক শক্তিতে নয়, বরং প্রশাসনিক সক্ষমতায় নির্ধারিত হচ্ছে। ভারত এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও রাস্তাঘাটের নিরাপত্তার ওপর নির্ভর করছে—এটি ছোট কোনো বার্তা নয়। এই অবস্থায় বাংলাদেশের দায়িত্ব হচ্ছে ভারসাম্য বজায় রাখা। আমাদের কৌশলগত অবস্থানকে কেবল ট্রানজিটের সীমায় না রেখে, তা উন্নয়ন, পরিবহন, ও আঞ্চলিক সহযোগিতার বৃহত্তর প্ল্যাটফর্মে রূপ দিতে হবে।
তবে ভারতকেও বুঝতে হবে, কৌশলগত বিকল্প কখনো স্থায়ী প্রতিস্থাপন হতে পারে না। মণিপুরকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের ওপর নির্ভরতা যুক্তিসঙ্গত হলেও, সেটি দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়। কারণ, যদি কোনো দিন রাজনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন দেখা দেয়, ভারতের পূর্বমুখী বাণিজ্য আবারও অনিশ্চয়তায় পড়বে। তাই ভারতের উচিত মণিপুরকে পুনর্গঠন করা, তার সামাজিক আস্থা ফিরিয়ে আনা, এবং সেই পথটিকে আবারও জীবিত করা। সেটিই হবে সত্যিকারের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’—একটি নীতি যা সংঘাত নয়, সংযোগ তৈরি করে।
বাংলাদেশের জন্য এই বাস্তবতা একদিকে সুযোগ, অন্যদিকে সতর্কতা। আমরা চাই, ভারত যেন তার অভ্যন্তরীণ ক্ষত সারিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিবেশী হয়ে ওঠে। কারণ, স্থিতিশীল ভারতই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত স্বার্থের পরিপূরক। তবু, আজকের বাস্তবতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, ভারত আমাদের সড়ক ও বন্দরের ওপর আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি নির্ভরশীল। আর এই নির্ভরতা আমাদের সামনে নতুন এক বাস্তবতা খুলে দিয়েছে—দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের ভূমিকা আর শুধু ভৌগোলিক নয়, এটি কৌশলগত।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা তাই ‘বাংলাদেশ না মণিপুর?’ নয়। এটি আরও বড় প্রশ্ন: ভারত কি সেই শক্তি হতে পারবে, যে কেবল প্রতিবেশীরা শান্ত থাকলেই এগোয়, নাকি সেই শক্তি, যে নিজের সীমান্তেও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে পথ তৈরি করে? বাংলাদেশের দৃষ্টিতে, উত্তরটি স্পষ্ট—একটি শক্তিশালী প্রতিবেশী মানে হলো, এমন এক রাষ্ট্র, যে নিজের সীমান্তে আস্থা ফিরিয়ে আনে, কিন্তু প্রতিবেশীর সীমান্তে স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। ভারত যদি সত্যিই বৈশ্বিক শক্তি হতে চায়, তবে তাকে বাংলাদেশের রাস্তা ব্যবহার করতেই হবে, তবে পাশাপাশি তাকে নিজের রাস্তা পুনর্নির্মাণ করতে হবে। কারণ, বড় শক্তি হওয়া মানে শুধু ভূগোল জয় নয়; মানে নিজের ভেতরের বিভাজন জয় করা।
বাংলাদেশ আজ যে সেতুটি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটি শুধু পণ্যবাহী নয়; এটি ইতিহাসবাহী। এই সেতুর দুই প্রান্তে রয়েছে দুই বাস্তবতা—একদিকে রক্তাক্ত মণিপুর, অন্যদিকে শান্তিপূর্ণ চট্টগ্রাম। এই দুই বাস্তবতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ এশিয়া ঠিক করছে তার ভবিষ্যৎ। যদি ভারত তার পূর্ব দরজাগুলো খুলে রাখতে চায়, তবে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতাকে সম্মান জানাতে হবে, আর যদি বাংলাদেশ তার ভূরাজনৈতিক প্রভাব ধরে রাখতে চায়, তবে তাকে এই নির্ভরতার সুযোগ নয়, দায়িত্ব হিসেবে নিতে হবে। কারণ, সত্যিকারের আঞ্চলিক শক্তি তারা-ই, যারা অন্যের ট্রাকের গতি নয়, নিজেদের পথের নিরাপত্তা দিয়ে নিজের মর্যাদা স্থাপন করে।
আপনার মতামত জানানঃ