
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম হঠাৎই রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে একটি গানের কারণে—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা “আমার সোনার বাংলা”। এই গান, যা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে পরিচিত, আসামের করিমগঞ্জ জেলার শ্রীভূমি শহরে কংগ্রেস সেবাদলের এক সভায় গাওয়া হয়। আর এতেই চাঞ্চল্য ছড়ায় পুরো রাজ্যে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা এই ঘটনাকে দেশদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন এবং কংগ্রেস কর্মীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করার নির্দেশ দিয়েছেন।
শুরুটা ছিল খুব সাধারণ। স্থানীয় কংগ্রেস নেতারা তাঁদের সভায় ঠাকুরের গানটি গেয়েছিলেন বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। কিন্তু ঘটনাটি ভিডিও হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই অন্য রূপ নেয়। বিজেপিশাসিত আসামের স্বাস্থ্যমন্ত্রী অশোক সিংঘল ভিডিওটি পোস্ট করে লেখেন, “কংগ্রেস সভায় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাওয়া হচ্ছে, যারা উত্তর-পূর্ব ভারতকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়।” সেই পোস্টের পর থেকেই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগের ঝড় ওঠে। বিজেপি নেতারা দাবি করতে থাকেন, কংগ্রেস ভোটের রাজনীতির জন্য “বাংলাদেশপ্রেমে” অন্ধ হয়ে গেছে এবং এভাবে তারা দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা বিপন্ন করছে।
এরই মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা নিজে প্রকাশ্যে বলেন, “কংগ্রেস নেতারা এমন এক সভা করছে যেখানে ভারতের নয়, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাওয়া হচ্ছে। এটি জাতির প্রতি অপমান এবং আইন অনুযায়ী এর শাস্তি হওয়া উচিত।” তাঁর নির্দেশে পুলিশকে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করতে বলা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এমনকি দাবি করেছেন, এই কাজটি বাংলাদেশের সেই রাজনৈতিক প্রচেষ্টারই অংশ, যেখানে উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু অঞ্চলকে বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্ত করার “স্বপ্ন” দেখা হচ্ছে, আর কংগ্রেস নাকি সেই ষড়যন্ত্রে সহায়তা করছে।
বিজেপির পক্ষ থেকে পুরো বিষয়টিকে এক রাজনৈতিক অভিযানে রূপ দেওয়া হয়। তাদের সামাজিক মাধ্যম পোস্টে বলা হয়, “কংগ্রেস এখন বাংলাদেশে আচ্ছন্ন। কয়েক দিন আগেই বাংলাদেশ মানচিত্রে উত্তর-পূর্ব ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করে যে বিতর্ক তৈরি করেছিল, কংগ্রেস এখন সেই মানসিকতা নিয়ে গর্বের সঙ্গে আসামে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাইছে।” তারা আরও লেখে, “যে ব্যক্তি এটি দেখেও কংগ্রেসের উদ্দেশ্য বুঝতে পারেন না, তিনি হয় অন্ধ, নয়তো মদদদাতা।”
কিন্তু এর বিপরীতে কংগ্রেসও নীরব থাকেনি। আসাম প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি গৌরব গগৈ সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, “আমার সোনার বাংলা গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হলেও এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টি, এবং এই গান বাঙালি সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত। বিজেপি বাঙালি ভাষা, সংস্কৃতি ও মানুষকে সবসময় অবমাননা করে এসেছে।” তাঁর বক্তব্য ছিল পরিষ্কার—ঠাকুরের লেখা একটি গান গাওয়া মানে কোনো দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ নয়, বরং বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা। গগৈ বলেন, বিজেপি রবীন্দ্রনাথের দর্শন বোঝে না, তারা কেবল বিভাজনের রাজনীতি করে, এবং আসামের প্রকৃত সমস্যাগুলো থেকে মানুষের মনোযোগ সরাতেই এই “মিথ্যা দেশদ্রোহ” বিতর্ক তৈরি করেছে।
ঘটনাটি রাজনৈতিকভাবে যেমন সংবেদনশীল, তেমনি সাংস্কৃতিক দিক থেকেও তা গভীর। “আমার সোনার বাংলা” কোনো বিদেশি গান নয়, এটি লেখা হয়েছিল ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে, যখন ভারত তখনো স্বাধীন হয়নি। গানটি ছিল একতার আহ্বান, বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতীক। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে গানটির শিকড় ভারতেই—বিশেষ করে বাংলার মাটিতে।
তাই গানটি গাওয়ার ঘটনাকে রাষ্ট্রদ্রোহ বলা অনেকের কাছেই অযৌক্তিক মনে হয়েছে। ইতিহাসবিদ ও সংস্কৃতি বিশারদদের মতে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ভারতীয় চিন্তার প্রতীক, তাঁর গান বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। “আমার সোনার বাংলা” যেমন বাংলাদেশের গর্ব, তেমনি এটি ভারতের সাহিত্য ও সঙ্গীতেরও অংশ। যে রাজ্যে লক্ষাধিক বাঙালি বাস করেন, সেখানে এই গান গাওয়া দেশদ্রোহ হতে পারে না।
আসামের জনসংখ্যা গঠনে বাঙালিদের অবদান বিশাল। রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে, বিশেষ করে বরাক উপত্যকায় বাঙালি ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই অঞ্চলে বাঙালি সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথের প্রভাব দীর্ঘদিনের। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এই পরিচয় সব সময়ই জটিল ছিল। আসামের পরিচয়ে “বাঙালি” শব্দটি অনেক সময়েই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, বিশেষ করে যখন অভিবাসন ইস্যু রাজনীতির কেন্দ্রে চলে এসেছে। বিজেপি বহুদিন ধরেই কংগ্রেসকে “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ” নিয়ে সহানুভূতিশীল বলে অভিযোগ করে আসছে। ফলে একটি সাংস্কৃতিক গানও এখন রাজনৈতিক প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও স্পষ্ট হলো, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পরিচয়ের রাজনীতি কতটা নাজুক। এখানে “বাঙালি” শব্দটি একদিকে ভাষা ও সংস্কৃতির পরিচায়ক, আবার অন্যদিকে রাজনৈতিক অভিযোগের লক্ষ্য। যখন কোনো কংগ্রেস কর্মী রবীন্দ্রনাথের গান গাইলেন, তখন তা অনেকের কাছে নিজের সংস্কৃতিকে উদযাপন; কিন্তু বিজেপির কাছে তা হয়ে গেল “বিদেশপ্রেম” ও “রাষ্ট্রদ্রোহ”।
এই বিতর্ক শুধু রাজনীতির নয়, এটি ভারতের বহুসংস্কৃতির ধারণাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে। ভারতের সংবিধান বাঙালি ভাষাসহ ২২টি ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে রাজনীতিই এখন বড় বাস্তবতা। রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার জন্য কেউ যদি রাষ্ট্রদ্রোহী হয়ে যান, তাহলে ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য কোথায় দাঁড়াবে?
অনেকে বলছেন, এই ঘটনাটি আসলে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক মেরুকরণের অংশ। আসামের মতো রাজ্যে জাতীয়তাবাদের আবেগকে কাজে লাগানো সবসময় ভোটের জন্য কার্যকর হাতিয়ার। বিজেপি সেই আবেগকে স্পর্শ করছে—তারা চায় মানুষ গানটি নয়, “বাংলাদেশ” শব্দটি নিয়ে ভাবুক। এভাবেই একটি সাংস্কৃতিক ঘটনা পরিণত হচ্ছে রাজনৈতিক অস্ত্রে।
অন্যদিকে কংগ্রেসও এই সুযোগে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে চাইছে। তারা বলছে, এই বিতর্ক আসামের প্রকৃত সমস্যা থেকে মনোযোগ সরানোর কৌশল—বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, সীমান্ত সমস্যা বা নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের মতো ইস্যুগুলো নিয়ে জনগণ যাতে না ভাবে।
যে গানটি একসময় বাঙালির ঐক্যের প্রতীক ছিল, আজ সেটি বিভাজনের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। অথচ রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন এই গানটি একতা আর ভালোবাসার ভাষায়—“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।” এই ভালোবাসাই আজ রাজনৈতিক সন্দেহের মুখে।
এই ঘটনাকে অনেকে দেখছেন এক সাংস্কৃতিক সংকট হিসেবে, যেখানে ভাষা, সংগীত ও সাহিত্যকে রাজনীতির ছুরিতে কেটে ফেলা হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের গানে “বাংলাদেশ” শব্দটি নেই, আছে শুধু বাঙালির মাটির গন্ধ, প্রকৃতির সৌন্দর্য ও ভালোবাসা। কিন্তু তাও আজ রাজনৈতিক প্রতীক হয়ে উঠেছে।
শেষ পর্যন্ত, এই বিতর্ক থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে একটাই বিষয়—ভারতে এখন গান, ভাষা, এমনকি সংস্কৃতিও রাজনৈতিক অস্ত্র হতে পারে। একটি গান গাওয়া বা না গাওয়া দিয়ে দেশপ্রেম পরিমাপ করা হয়, ইতিহাসের ব্যাখ্যা বদলে দেওয়া হয়, আর মানুষ বিভক্ত হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার বলেছিলেন, “দেশপ্রেম সেই মানুষদের জন্য নয়, যারা নিজেদের দেশকে অন্যদের ঘৃণা দিয়ে ভালোবাসে।” আজ তাঁর সেই কথাই নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কারণ, যদি বাঙালি সংস্কৃতির এক গান গাওয়া দেশদ্রোহ হয়, তবে মানবতার সুর কোথায় হারিয়ে গেল?
আপনার মতামত জানানঃ