
বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতা যেন এক নতুন বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। যুদ্ধ, বাণিজ্যিক অনিশ্চয়তা, সুদের হার পরিবর্তন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর নীতিনির্ধারণ—সবকিছু মিলেই তৈরি করছে এক জটিল অর্থনৈতিক চিত্র। এই জটিলতার মধ্যেই মরগান স্ট্যানলি সম্প্রতি যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তা বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ব্যাপকভাবে। তাদের ধারণা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মাঝামাঝি নাগাদ স্বর্ণের দাম আউন্সপ্রতি ৪৫০০ ডলারে পৌঁছাতে পারে। এই পূর্বাভাস কেবল একটি সংখ্যা নয়; বরং এটি বিশ্ব অর্থনীতির দিকনির্দেশক, মানুষের বিনিয়োগ মনোভাবের প্রতিফলন, এবং অনিশ্চয়তার ভেতর আশ্রয় খোঁজার প্রতীক।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি ও সুদের হার নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ বিরাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত ও নীতিগত দ্বিধা বাজারে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। ফেড যদিও কিছুটা সুদহার কমিয়েছে, কিন্তু চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলের কঠোর ভাষা বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাসে আঘাত হেনেছে। এর ফলে নিরাপদ সম্পদ হিসেবে স্বর্ণের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে বহুগুণে। গত এক বছরে স্বর্ণের দাম প্রায় ৫৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে, যা বিগত কয়েক দশকে দেখা যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও তাদের রিজার্ভে স্বর্ণের অংশ বাড়াচ্ছে, বিশেষ করে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। এই ক্রয়চাপ বাজারে একটি স্থায়ী উর্ধ্বমুখী প্রবণতা তৈরি করছে।
স্বর্ণের এই ঊর্ধ্বগতি কেবল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রয়েই সীমাবদ্ধ নয়। বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও ইটিএফ বা এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ডের মাধ্যমে স্বর্ণে বিনিয়োগের আগ্রহ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুদের হার কমলে বিনিয়োগকারীরা সাধারণত ঝুঁকিহীন সম্পদের দিকে ঝুঁকেন, এবং স্বর্ণ ঐতিহাসিকভাবে সেই নিরাপদ আশ্রয়ের প্রতীক। মরগান স্ট্যানলি বলছে, আগামী বছরগুলোতে যখন বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা বাড়বে, তখন স্বর্ণভিত্তিক ইটিএফগুলোতে বিনিয়োগের প্রবাহ আরও তীব্র হবে। এই প্রবণতা স্বর্ণের দামকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে, অলঙ্কার শিল্পেও চাহিদা মোটামুটি স্থিতিশীল থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা সামগ্রিকভাবে চাহিদার ভারসাম্য রক্ষা করবে।
তবে সব পূর্বাভাসই যে নিখুঁতভাবে বাস্তবায়িত হবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। মরগান স্ট্যানলির বিশ্লেষকরাই বলছেন, দাম বাড়ার পাশাপাশি অস্থিরতার ঝুঁকিও রয়ে গেছে। যদি বৈশ্বিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরে আসে অথবা বিনিয়োগকারীরা নতুন লাভজনক সম্পদে ঝুঁকে পড়ে, তবে স্বর্ণের দাম কিছুটা নিম্নমুখী হতে পারে। এছাড়া কিছু কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের রিজার্ভ পুনর্গঠন করতে গিয়ে স্বর্ণ বিক্রির সিদ্ধান্তও নিতে পারে। এই সমস্ত উপাদান মিলিয়ে বাজারে একটি সাময়িক সংশোধনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তবে ইতিহাস বলছে, অর্থনৈতিক সংকট যত গভীর হয়, স্বর্ণের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ততই দৃঢ় হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার সময়েও স্বর্ণের দাম আকাশছোঁয়া হয়েছিল। কারণ, মানুষ যখন কাগুজে অর্থে আস্থা হারায়, তখন তারা ঝুঁকিমুক্ত সম্পদে আশ্রয় নেয়, আর সেই আশ্রয়ের নামই স্বর্ণ। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ইউরোপে জ্বালানি সংকট, চীনের অর্থনীতির মন্দাভাব, এবং যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক অস্থিরতা—সবকিছু মিলেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়াচ্ছে। এই অনিশ্চয়তাই স্বর্ণের চাহিদাকে আগামী বছরগুলোতে টিকিয়ে রাখবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।
আন্তর্জাতিক বাজারের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, স্পট মার্কেটে গত সপ্তাহের শেষে স্বর্ণের দাম দাঁড়িয়েছে আউন্সপ্রতি ৪০০১ ডলার ৭৪ সেন্টে। যদিও এটি আগের দিনের তুলনায় কিছুটা কম, তবুও টানা তিন মাস ধরে দাম বৃদ্ধির ধারা বজায় রয়েছে। অক্টোবরে এক মাসেই দাম বেড়েছে ৩.৭ শতাংশ। এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো ফেডের সুদহার নিয়ে দ্বিধা এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চিত নীতিগত ইঙ্গিত। মেটাল অ্যানালিস্ট টাই উয়াং বলেন, ফেডের ক্লিভল্যান্ড শাখার প্রেসিডেন্ট বেথ হ্যাম্যাকের কঠোর অবস্থান বাজারে স্বল্পমেয়াদি নিম্নচাপ সৃষ্টি করেছে, তবে মূল প্রবণতা এখনো ঊর্ধ্বমুখী। এই অস্থিরতার মধ্যেই ভবিষ্যতের বাজার সম্ভাবনা নির্ভর করছে নীতিনির্ধারকদের পরবর্তী সিদ্ধান্তের ওপর।
অর্থনীতির বৃহত্তর চিত্রে স্বর্ণের ভূমিকা এখন অনেকটাই মনস্তাত্ত্বিক। বিনিয়োগকারীরা কেবল মুনাফার জন্য নয়, বরং নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় হিসেবে স্বর্ণে বিনিয়োগ করেন। তাই, যদি সুদহার আরও কমে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা দেরিতে ফিরে আসে, তবে স্বর্ণের দাম ৪৫০০ ডলার অতিক্রম করাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাছাড়া, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও নতুন প্রযুক্তির উত্থানের ফলে তথ্যপ্রবাহ দ্রুত হলেও বাজারে গুজব ও আতঙ্কও আগের চেয়ে দ্রুত ছড়ায়—যা অস্থিরতার জ্বালানি হিসেবে কাজ করে।
সবশেষে, এই প্রেক্ষাপটে স্বর্ণের বাজারকে বোঝা মানে কেবল অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান পড়া নয়, বরং মানুষের মনস্তত্ত্ব ও ভয়ের গতিপথ অনুধাবন করা। যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতি, কিংবা রাজনৈতিক টানাপোড়েন—সবকিছুর মধ্যেই মানুষ নিরাপদ বিনিয়োগের খোঁজে থাকে। স্বর্ণ সেই আশ্রয়ের নাম, যা হাজার বছর ধরে মানবসভ্যতার বিশ্বাস বহন করে আসছে। ২০২৬ সালের মাঝামাঝি যদি সত্যিই আউন্সপ্রতি দাম ৪৫০০ ডলারে পৌঁছে যায়, তবে তা হবে শুধু বাজারের নয়, বরং মানবিক অনিশ্চয়তার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়। অর্থনীতির প্রতিটি চক্রের শেষে যে জিনিসটি মানুষ আঁকড়ে ধরে—তা হলো স্থায়িত্ব, আর সেই স্থায়িত্বের প্রতীক স্বর্ণ, এখনো আগের মতোই অমলিন।
আপনার মতামত জানানঃ