
গত দেড় দশকে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ এমনভাবে বেড়েছে যে এটি এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্য যেকোনো দেশের বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে গেছে। এই সময়ে দেশের রপ্তানি আয় যে হারে বাড়েনি, তার তুলনায় ঋণ পরিশোধের পরিমাণ কয়েক গুণ বেশি বেড়ে যাওয়ায় বিশেষজ্ঞরা বিষয়টিকে উদ্বেগজনক প্রবণতা হিসেবে দেখছেন। বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক ঋণ প্রতিবেদন ২০২৫ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো মিলিয়ে মোট ৯৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে, যা ১৫ বছর আগের তুলনায় ২৫৩ শতাংশ বেশি। এই অঞ্চলে সবচেয়ে দ্রুত পরিশোধ বৃদ্ধি ঘটেছে বাংলাদেশে—২০২৪ সালে মোট ঋণ পরিশোধ ছিল ৭.৩ বিলিয়ন ডলার, যা ২০১০ সালের তুলনায় ৬১৭ শতাংশ বৃদ্ধি।
এই বিশাল বৃদ্ধির পেছনে দুটি বড় উপাদান ছিল—মূল ঋণ পরিশোধ এবং সুদ পরিশোধ। ২০১০ সালে যেখানে বাংলাদেশের মূল ঋণ পরিশোধ ছিল মাত্র ৮২১ মিলিয়ন ডলার, ২০২৪ সালে তা লাফিয়ে উঠে হয়েছে ৪.৯ বিলিয়ন ডলার। একইভাবে, সুদ পরিশোধ ২০১০ সালের মাত্র ২০৩ মিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে দাঁড়িয়েছে ২.৪ বিলিয়ন ডলার। তুলনায় পাকিস্তানের পরিশোধ গত ১৫ বছরে বেড়েছে ২৫১ শতাংশ, ভারতের ২৪৬ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার ২১১ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধ বৃদ্ধির হার কোনোভাবেই স্বাভাবিক বৈশ্বিক প্রবণতার মধ্যে পড়ে না; বরং এটি অঞ্চলব্যাপী অস্বাভাবিকভাবে দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া একটি দেশ।
এমন বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে—কেন বাংলাদেশের পরিশোধের বোঝা এত দ্রুত বাড়ছে? অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, গত দেড় দশকে দেশের বৈদেশিক ঋণ নির্ভরতা বেড়েছে, কিন্তু সেই ঋণ ব্যয়ের ক্ষেত্রে দক্ষতা, সুশাসন এবং আর্থিক জবাবদিহিতা যথেষ্ট শক্তিশালী হয়নি। নতুন নতুন বৃহৎ প্রকল্প নেওয়া, প্রকল্প ব্যয় অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া, ব্যয়-সাশ্রয়ী পরিকল্পনার অভাব এবং কখনও কখনও প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ এই বোঝা বাড়িয়েছে। রপ্তানি আয় বাড়েনি সে অনুপাতে, বরং অনেক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা প্রকল্পগুলো কাঙ্ক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ তৈরি করতে পারেনি।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হুসাইন বলেন, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের এই দ্রুত বৃদ্ধি জাতীয় বাজেট প্রণয়নের স্বাধীনতাকে কমিয়ে দিচ্ছে। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, যখন সরকারের আয়ের একটি বড় অংশ ঋণ পরিশোধে বরাদ্দ দিতে হয়, তখন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়ন কিংবা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে ব্যয় কমে যায়। অর্থাৎ ঋণ পরিশোধের চাপ শুধুমাত্র পরিসংখ্যানগত সমস্যা নয়; এটি অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ কাঠামোকেও প্রভাবিত করে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ-রপ্তানি অনুপাত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) মনে করে, কোনো দেশের বৈদেশিক ঋণ যদি বার্ষিক রপ্তানি আয়ের ১৮০ শতাংশের বেশি হয়, তবে সেই দেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশের এই অনুপাত ১৯২ শতাংশ। অর্থাৎ, বাংলাদেশ এখন আইএমএফের নির্ধারিত সতর্কসীমা অতিক্রম করে মধ্যম ঝুঁকিযুক্ত দেশে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতির কারণে আইএমএফ ২০২৪ সালে বাংলাদেশের ঝুঁকি রেটিং “লো” থেকে “মডারেট”-এ নামিয়ে আনে। বাংলাদেশ আগে দীর্ঘদিন ধরে কম ঝুঁকির দেশ ছিল, যা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এখন এই রেটিং কমে যাওয়ায় নতুন আন্তর্জাতিক ঋণ নেওয়া আরও ব্যয়বহুল হতে পারে, কারণ সুদের হার ও শর্ত আরও কঠোর হতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১০ সালে যেখানে বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণ ছিল ২৬ বিলিয়ন ডলার, ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৪ বিলিয়ন ডলার। এই বিশাল বৃদ্ধির ফলে দেশের রপ্তানি আয়ের ওপর চাপ আরও তীব্র হয়েছে—২০২৪ সালে রপ্তানি আয়ের ১৬ শতাংশই খরচ হয়েছে ঋণ পরিশোধে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, একই সময়ে দেশের রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) টানা ১৩ বছর ধরে তাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে সরকারের আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে যে ফাঁক তৈরি হয়েছে, তা পূরণ করতে আরও ঋণ নিতে হয়েছে, যা আবার পরিশোধের জন্য ভবিষ্যৎ রপ্তানি আয়ের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করছে।
এরকম পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদ মুস্তাফিজুর রহমান সতর্ক করেছেন যে, বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ “ঋণ ফাঁদে” পড়ে যেতে পারে। ঋণ ফাঁদের ধারণাটি হলো—যখন একটি দেশ পুরনো ঋণ পরিশোধ করতে নতুন ঋণ নিতে বাধ্য হয়, এবং ঋণের চাপ বছর বছর বাড়তেই থাকে। এই ফাঁদের উদাহরণ আমরা শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো দেশে স্পষ্টভাবে দেখেছি। তাঁদের মতে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখনই সেই অবস্থায় না পৌঁছালেও তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এ পর্যায়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান আরও স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “আমরা ইতিমধ্যেই ঋণ ফাঁদে পড়েছি। সত্যটি স্বীকার না করলে সামনে এগোনো সম্ভব নয়।”
তবে জাহিদ হুসাইনের মূল্যায়ন খানিকটা ভিন্ন। তিনি স্বীকার করেন যে পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু এখনই ভয়াবহ সংকট নয়। তবে তিনি স্পষ্টতই সতর্ক করেন যে, ঋণ নেওয়া ও পরিশোধের যে গতি, তা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বাংলাদেশও অল্প সময়ের মধ্যেই বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়তে পারে। তিনি বলেন, “যদি কোনো প্রকল্পের প্রকৃত ব্যয় ১০০ টাকা হয়, আর আপনি ৫০০ টাকা ব্যয় দেখান এবং বাকি অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যায়, তবে ঋণ শোধ হবে কীভাবে?” তাঁর এই বক্তব্য প্রকল্প ব্যয়ের অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির ইঙ্গিত দেয়, যা আন্তর্জাতিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিনের সমস্যা।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের অবস্থা এখনও খুব খারাপ নয়, তবে সেই পথে এগোচ্ছে। পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণ-রপ্তানি অনুপাত ৩১৫ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ২৮০ শতাংশ এবং নেপালের ২৩৪ শতাংশ। অর্থাৎ তাদের তুলনায় বাংলাদেশের অনুপাত এখনও কম, কিন্তু বৃদ্ধি হারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থাই সবচেয়ে উদ্বেগজনক। অন্যদিকে ভারতের অনুপাত ৮২ শতাংশ এবং ভিয়েতনামের মাত্র ৩১ শতাংশ, যা তাদের শক্তিশালী রপ্তানি সক্ষমতার প্রতিফলন।
এই পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছু করণীয় তুলে ধরেছেন। প্রথমত, এমন প্রকল্পগুলো পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে যেগুলো রপ্তানি আয় বৃদ্ধি বা বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে না। চলমান কিন্তু আয়-সৃষ্টির সম্ভাবনা কম এমন প্রকল্পগুলোর সময়সীমা পুনর্গঠনের পরামর্শও তাঁরা দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, যেসব প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে কিন্তু বাস্তবায়ন শুরু হয়নি, সেগুলো নতুনভাবে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে যাচাই করা দরকার—আসলেই সেগুলো দেশের প্রয়োজন কিনা। তৃতীয়ত, ভবিষ্যতের ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে আরও কঠোর শর্ত আরোপের প্রয়োজন আছে, যাতে প্রকল্প ব্যয়ে অপচয় বা দুর্নীতি না ঘটে।
বাংলাদেশের ঋণ পরিস্থিতি বোঝার জন্য বিশ্বব্যাপী ঋণের প্রবণতাও গুরুত্বপূর্ণ। গত দুই বছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বিশ্বজুড়ে বেড়েছে—২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলো নতুন অর্থায়নের চেয়ে ৭৪১ বিলিয়ন ডলার বেশি ঋণ ও সুদ পরিশোধ করেছে। এটিকে বলা হচ্ছে অর্ধশতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে বড় নেট বহিঃপ্রবাহ। ২০২৪ সালে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মোট বৈদেশিক ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮.৯ ট্রিলিয়ন ডলার। বিশেষ করে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ৭৮টি দেশের ঋণই ১.২ ট্রিলিয়ন ডলার, যা তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতার ওপর বিরাট চাপ তৈরি করছে। বৈশ্বিক সুদের হারও ২০০৮–০৯ সালের আর্থিক সংকটের আগের সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে, ফলে ঋণ নেওয়া আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান ঋণ পরিস্থিতি একটি স্পষ্ট সতর্ক সংকেত। সঠিক সিদ্ধান্ত দ্রুত না নিলে পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আরও জটিল হতে পারে। তবে এখনও সুযোগ আছে—প্রকল্প ব্যয়ে স্বচ্ছতা, রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য, রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি এবং যথাযথ ঋণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের ঋণভার নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ