২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে এক অনন্য রাজনৈতিক দৃশ্যপটের উদ্ভব ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ পেশাজীবী, এবং অনলাইন-সচেতন নাগরিক সমাজের তরুণ অংশ—সবাই যেন এক নতুন রাজনৈতিক জাগরণের দিকে ধাবিত হয়। এটি ছিল এমন এক সময় যখন বহু বছরের রাজনৈতিক স্থবিরতা ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতি জনরোষ নতুন আকারে প্রকাশ পায়। “জেনারেশন জেড রেভলিউশন” নামে পরিচিত এই আন্দোলন কেবল একটি ছাত্র আন্দোলন ছিল না; এটি ছিল এক যুগান্তকারী সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনার স্ফুরণ, যেখানে তরুণরা প্রথমবারের মতো বিশ্বাস করেছিল যে পরিবর্তন সম্ভব। তারা মনে করেছিল, পুরনো রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও দলীয় স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে তাদের আওয়াজই হবে বাংলাদেশের নতুন ভোরের সূচনা।
কিন্তু কয়েক মাসের ব্যবধানে সেই জাগরণ আজ নিস্তেজ। যে সামাজিক উত্তেজনা ও উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল, তা এখন ধীরে ধীরে থমকে যাচ্ছে। এই প্রশ্ন এখন ঘুরে ফিরে আসছে—বাংলাদেশের জেনারেশন জেড রেভলিউশন কি আসলেই ধ্বসে পড়ছে? নাকি এটি একটি সাময়িক স্থবিরতা, যেখান থেকে নতুন রূপে পুনর্জন্ম নেওয়া সম্ভব? উত্তর হয়তো একপেশে নয়, কারণ এই আন্দোলনের উত্থান যেমন হঠাৎ ছিল, তার সংকটও তেমনি বহুস্তরীয় ও জটিল।
এই আন্দোলনের মূল প্রেক্ষাপটে ছিল চাকরিক্ষেত্রে কোটা সংস্কার, সুশাসন, এবং সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার দাবি। তবে দ্রুতই বিষয়টি কেবল একটি দাবি নয়, বরং একটি প্রজন্মের হতাশা ও ক্ষোভের প্রতীক হয়ে ওঠে। তরুণরা বুঝতে পারে, রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব—সবখানেই এক ধরনের স্থায়ী অচলাবস্থা চলছে। তাদের কাছে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার ও সমান সুযোগের ধারণা যেন কেবল বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ। ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে ওঠে তাদের প্রধান অস্ত্র, আর রাস্তা হয়ে ওঠে প্রতিবাদের মঞ্চ। স্লোগান ওঠে—“আমরাই ভবিষ্যৎ, আমরাই পরিবর্তন।” কিন্তু পরিবর্তন কখনও একমুখী হয় না; এর সঙ্গে থাকে প্রতিক্রিয়াও।
রাষ্ট্রের ক্ষমতাকেন্দ্র দ্রুত বুঝে ফেলে যে এই আন্দোলন কেবল একটি নীতিগত আপত্তি নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। তাই শুরু হয় দমনপীড়ন, নজরদারি ও প্রোপাগান্ডার খেলা। আন্দোলনের নেতাদের অনেকে গ্রেফতার হন, কেউ কেউ বিদেশে চলে যেতে বাধ্য হন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে চালানো হয় সমন্বিত বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা। কিছু সময় পর আন্দোলনের ভেতরে দেখা দেয় বিভাজন—কেউ চান সরাসরি রাজনীতিতে প্রবেশ করে পরিবর্তন আনা, কেউ আবার চান নিরপেক্ষ নাগরিক আন্দোলনের পথেই থাকা। এই মতাদর্শগত ফাটল আন্দোলনের শক্তিকে দুর্বল করে দেয়।
একইসঙ্গে দেশের পুরনো রাজনৈতিক শক্তিগুলোও নিজেদের অবস্থান পুনর্গঠন করতে শুরু করে। শাসক দলের বিরোধীরা এই তরুণ আন্দোলনকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়, আবার শাসক দল এটিকে রাষ্ট্রবিরোধী বলে দাগিয়ে দেয়। ফলে তরুণদের সামনে আসে এক ত্রিমুখী চাপ—রাষ্ট্রীয় দমন, রাজনৈতিক দখল, এবং আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ ভাঙন। এই ত্রিমুখী চাপে আন্দোলনের গতি হারাতে থাকে। মিডিয়ার আলোচনায় নতুন বিষয় আসে, তরুণদের প্রতিবাদ খবরের শিরোনাম থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করে।
তবুও, পুরোপুরি শেষ হয়নি কিছুই। অনেক তরুণ এখনো মনে করেন, এই পরিবর্তনের বীজ একবার বপন হয়েছে এবং তা আবারও অঙ্কুরিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে, অনলাইন ফোরামে, কিংবা স্থানীয় সংগঠনগুলোর উদ্যোগে—এই নতুন চিন্তার বীজ এখনও ছড়িয়ে আছে। তবে সেটি ছড়িয়ে আছে ছায়ায়, আলোতে নয়। এই ছায়া রাজনীতি বা লুকিয়ে থাকা আন্দোলন হয়তো একদিন আবার আলোর মুখ দেখবে, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন দিকনির্দেশনা, সংগঠন এবং এক ধরনের নতুন নেতৃত্বের ধারণা।
একটি বড় সমস্যা হচ্ছে নেতৃত্বের সংকট। জেনারেশন জেড আন্দোলনের মূলধারার মুখপাত্ররা অনেকেই এখন হতাশ, বিভ্রান্ত, কিংবা প্রান্তিক হয়ে পড়েছেন। কারও মতে, নেতৃত্বের অভাবে এই আন্দোলন তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি; আবার কারও মতে, নেতৃত্বের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আসলে আন্দোলনের আত্মাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। কারণ তরুণদের আন্দোলন কখনোই একক নেতৃত্ব নির্ভর হওয়া উচিত নয়—এটি হওয়া উচিত ধারণা ও চেতনা নির্ভর। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় সংগঠিত রূপ ছাড়া কোনো আন্দোলন টেকসই হয় না, এই বাস্তবতা এখন আরও প্রকট।
অর্থনৈতিক বাস্তবতাও এখানে একটি বড় ভূমিকা রাখছে। দেশের বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, ও আয় বৈষম্য তরুণদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের আগ্রহকে ক্ষয় করছে। একজন তরুণ যিনি প্রতিদিন নিজের জীবনধারণ নিয়েই লড়ছেন, তার পক্ষে দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় থাকা কঠিন। তাই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রাখার জন্য দরকার ছিল সাংগঠনিক সমর্থন, যা অনুপস্থিত ছিল। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ঘাটতি এবং দেশের ভেতর নাগরিক সমাজের দুর্বল অবস্থানও এই ধসের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম।
এদিকে, কিছু তরুণ যাঁরা রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন, তাঁরা পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেননি। দুর্নীতি, ক্ষমতা লালসা, ও দলে দলে বিভাজন তাঁদেরও গ্রাস করছে। ফলে যে আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল এক নতুন রাজনীতি সৃষ্টি করা, তা এখন পুরনো রাজনীতির ছাঁচে ঢালাই হতে শুরু করেছে। কেউ কেউ বলছেন, “রেভলিউশন” শব্দটি এখন আর বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না—এটি হয়ে গেছে এক ধরনের নস্টালজিক স্মৃতি, যা তরুণেরা মাঝে মাঝে স্মরণ করে, কিন্তু সক্রিয়ভাবে ধারণ করে না।
তবে এও সত্য যে, ইতিহাসে কোনো আন্দোলন কখনোই পুরোপুরি হারিয়ে যায় না। ১৯৫২, ১৯৭১, কিংবা ১৯৯০ সালের মতো প্রতিটি রাজনৈতিক পরিবর্তনই কোনো না কোনো সময়ের তরুণদের হাতেই এসেছিল। বর্তমান প্রজন্মের রেভলিউশন হয়তো এখন ক্ষীণ আলোয় টিকে আছে, কিন্তু সেটিই আবার ভবিষ্যতের অগ্নিশিখায় পরিণত হতে পারে। কারণ তরুণরা কেবল ক্ষণস্থায়ী উত্তেজনায় নয়, দীর্ঘমেয়াদী আদর্শেও অনুপ্রাণিত হতে পারে—যদি তাদের সামনে থাকে স্বপ্নের একটি বাস্তব রূপরেখা।
আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে নতুন প্রজন্মের ভূমিকা হয়তো ক্ষীণ, কিন্তু তাদের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। তারা এখন সাংবাদিকতা, প্রযুক্তি, উদ্যোক্তা-চর্চা, ও নাগরিক উদ্যোগের ভেতর দিয়ে নতুন এক সামাজিক রাজনীতি তৈরি করছে। এটি হয়তো সরাসরি পার্লামেন্ট বা রাস্তায় প্রতিফলিত হচ্ছে না, কিন্তু অনলাইন ও সাংস্কৃতিক পরিসরে এর অভিঘাত স্পষ্ট। এটি আসলে “সফট রেভলিউশন”—যেখানে তরুণরা মতপ্রকাশের নতুন ধরন তৈরি করছে, যা হয়তো একদিন বাস্তব রাজনীতির দিকেও প্রভাব ফেলবে।
তাই বলা যায়, জেনারেশন জেড রেভলিউশন পুরোপুরি ধ্বসে পড়েনি; বরং এটি রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় আছে। এর এক অংশ হারিয়ে গেছে হতাশা ও বিভাজনে, কিন্তু আরেক অংশ গড়ে উঠছে নতুন মাধ্যম ও নতুন চিন্তায়। সময়ই বলে দেবে, এই নতুন তরঙ্গ আবারও শক্তিশালী হয়ে উঠবে কি না। তবে একথা নিশ্চিত—এই প্রজন্ম আর আগের মতো নিঃশব্দ নয়। তারা হয়তো আর আগের মতো রাস্তায় নেই, কিন্তু তাদের কণ্ঠস্বর এখনও ইন্টারনেটে, আলোচনায়, এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
আমার মতে, এই আন্দোলনের ধ্বস নয়—এটি এক ধরনের অন্তর্গত পুনর্গঠন। ইতিহাস সবসময় সরলরেখায় চলে না; মাঝেমধ্যে থেমে যায়, পথ হারায়, আবার নতুন করে ফিরে আসে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম এখন সেই মধ্যবর্তী পর্যায়ে আছে—যেখানে হতাশা আর আশার মিশ্রণই পরবর্তী ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। যদি তারা নিজেদের বিশ্বাসে অটল থাকে, এবং নিজেদের ভবিষ্যৎকে রাজনৈতিক নয়, সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে দেখে, তাহলে এই রেভলিউশন আবারও জেগে উঠবে। আর যদি তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তাহলে সত্যিই এটি ইতিহাসের এক অপ্রাপ্তবয়স্ক অধ্যায় হয়েই থেকে যাবে।
আপনার মতামত জানানঃ