নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে আন্দোলনকারীর মৃত্যু, বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় রাজনৈতিক কর্মীর প্রাণহানি এবং সেইসব ঘটনাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এক বিভ্রান্তিকর ও বিভাজিত পরিসংখ্যানের চিত্র। জুলাই-অগাস্ট ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে নিহতদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে, তা এখন শুধু মানবিক নয়, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক জটিলতার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
সরকারি গেজেটে ‘শহীদ’ হিসেবে স্বীকৃত নিহতদের সংখ্যা দেখানো হয়েছে ৮৪৪ জন, যা সরকারের তথ্য অনুযায়ী আন্দোলনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কর্মীদের হাতে প্রাণ হারানো নাগরিকদের নামেই সীমাবদ্ধ। অথচ জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন তাদের তদন্তে জানাচ্ছে, প্রায় ১৪০০ জন মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের অনেকে শিশুও ছিল এবং বেশিরভাগই প্রাণ হারিয়েছেন রাইফেল বা শটগানের গুলিতে। দুই তালিকার মধ্যকার এই প্রায় দ্বিগুণ পার্থক্য কেবল তথ্যভিত্তিক বিভ্রান্তিই নয়, বরং সরকারের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে।
সরকারি পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তালিকা তৈরি হয়েছে জেলা প্রশাসন, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যের ভিত্তিতে। সেই তালিকা অনুযায়ী প্রথম গেজেটে ৮৩৪ জনের নাম আসে, পরে তা হালনাগাদ করে ৮৪৪ করা হয়। কিন্তু ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে এই তালিকায় অনেকে দ্বিগুণভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, কেউ কেউ সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘটনায় নিহত হয়েও জায়গা পেয়েছেন, আবার অনেক বেওয়ারিশ মরদেহ বা অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি বাদ পড়ে গেছেন। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের তথ্যমতে, ঢাকার রায়েরবাজারে গত বছর জুলাই ও অগাস্ট মাসে ১১৪টি মরদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছিল, যাদের অনেকেই হয়তো আন্দোলনে নিহত হলেও তাদেরকে সরকারি গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
এই অসামঞ্জস্যতা কেবল তথ্যগত ভুল নয়, বরং রাজনৈতিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। সরকারি তালিকায় নিহত শুধু সেই আন্দোলনকারীদের নাম এসেছে, যারা সরকারি বাহিনী বা ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের হাতে মারা গেছেন। কিন্তু জাতিসংঘের হিসাব বলছে, ওই সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষুব্ধ জনতার হাতেও পুলিশ সদস্যসহ অন্য রাজনৈতিক কর্মীদের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশের তৈরি একটি আলাদা তালিকায় বলা হয়েছে, আন্দোলনের সময় ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। অথচ তাদের নাম সরকারি শহীদ গেজেটে নেই।
অন্যদিকে, মানবাধিকার সংস্থা এইচআরএসএস-এর মতে, ১৬ জুলাই থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৮৭৫ জন নিহত হয়েছে, যার বেশিরভাগই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে। এই পরিসংখ্যান সরকারের চেয়ে বেশি, কিন্তু জাতিসংঘের চেয়ে কম। এটি দেখায়, নিহতদের সংখ্যা কেবল এক সূত্র থেকে নয়, বরং নানা পক্ষের, নানা উদ্দেশ্যে পরিচালিত তথ্য সংগ্রহের ফলে বিভিন্ন হিসাবের জন্ম দিচ্ছে।
গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ যথার্থভাবে প্রশ্ন তুলেছেন—যেখানে প্রশাসনিক উদ্যোগের পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ বা চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে, সেখানে ভুয়া নাম যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। তালিকায় তাড়াহুড়ো, আবার কখনো ঢিলেমি, সরকারি অদক্ষতা এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতার সমন্বয়ে নিহতদের একটি নির্ভুল, মানবিক ও ন্যায্য তালিকা প্রণয়ন এক বছরের মধ্যেও সম্ভব হয়নি। যার ফলে আন্দোলনের ইতিহাস এখন কেবল রক্তাক্ত নয়, বিভ্রান্তিকরও।
এই পরিস্থিতিতে সরকারকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও দ্রুততর তদন্ত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে, যাতে একদিকে যেন সত্য আড়াল না হয়, অন্যদিকে যেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো যথাযথ মর্যাদা ও সহায়তা পায়। একইসঙ্গে জাতিসংঘের সঙ্গে যৌথ তদন্তের সুযোগ উন্মুক্ত করে দিলে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের মানবাধিকার রেকর্ড কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার হতে পারে।
শেষত, এই ঘটনাগুলো শুধু পরিসংখ্যান নয়, প্রতিটি সংখ্যা একেকটি পরিবার, একেকটি জীবনের গল্প। সেইসব জীবনের প্রতি সম্মান জানিয়ে যত দ্রুত নির্ভুল তালিকা তৈরি হবে, তত দ্রুত রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালনের পথে এগিয়ে যাবে—না হলে এই গণঅভ্যুত্থান কেবল একটি রাজনৈতিক পালাবদলের ইতিহাস নয়, রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার একটি দীর্ঘ ছায়া হয়ে থাকবে।
আপনার মতামত জানানঃ