৬৭ বছরের আনোয়ারা বেগম জীবনের এমন এক অধ্যায়ে পৌঁছেছেন, যেখানে তার সন্তান-পরিজনের সান্নিধ্যে নিশ্চিন্ত দিন কাটানোর কথা ছিল। অথচ আজ তার ঠিকানা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অন্ধকার কক্ষ। দীর্ঘদিন ব্যবসা পরিচালনা করে তিনি পরিবারের জন্য একটি স্থিতিশীল জীবন গড়ে তুলেছিলেন। কাকরাইলের কার হাউজ লিমিটেডের অর্ধেক মালিকানা তার হাতে ছিল। কিন্তু স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে সম্পত্তি নিয়ে শুরু হয় পারিবারিক দ্বন্দ্ব। তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে ছোট ছেলে তৌহিদ আনোয়ার অভিক মায়ের অংশটুকু দখল করার জন্য নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
পরিবারের অভিযোগ, সম্পত্তি একক মালিকানা করার নেশায় অভিক মাকে ভয়ভীতি দেখাতেন এবং বারবার চাপ প্রয়োগ করতেন। আইনি জটিলতার কারণে পরিকল্পনায় সফল না হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি মাকে হত্যা মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার পথ বেছে নেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘটিত হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোতে একে একে আনোয়ারা বেগমের নাম যুক্ত হয়। যাত্রাবাড়ী থানার একটি মামলায় তিনি ১৬৭ নম্বর আসামি, উত্তরা পূর্ব থানার আরেক মামলায় ১৪০ নম্বর আসামি এবং পরবর্তী মামলায় ৬৪ নম্বর আসামি হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। বয়স ও স্বাস্থ্য বিবেচনায় যেখানে তার শান্তিপূর্ণ জীবন কাটানোর কথা ছিল, সেখানে হঠাৎ করেই তাকে অপরাধীর আসনে দাঁড় করানো হয়।
সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো, পুলিশি প্রতিবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে—আনোয়ারা বেগমের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বাদীপক্ষ থেকেও তার বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপিত হয়নি। তবুও তাকে একের পর এক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। পরিবারের দাবি, এই প্রক্রিয়া নিছকই মায়ের সম্পত্তি দখলের ষড়যন্ত্র।
আনোয়ারার ভাই মেজবাহ উদ্দিন লিটন বলেন, “আমার বোন কখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তিনি নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপি’র সদস্য ছিলেন। অথচ মামলায় তাকে আওয়ামী লীগ নেত্রী হিসেবে দেখানো হয়েছে।” তিনি আরও জানান, মামলাবাজ একটি গোষ্ঠীর সহযোগিতায় টাকার বিনিময়ে বোন আনোয়ারা বেগম এবং তার ঘনিষ্ঠজনদের নাম মামলায় ঢোকানো হয়। শুধু আনোয়ারা নয়, তার ভাই লিটন নিজেও একইভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। এমনকি আরেক বোন জাহানারা বেগম, পারিবারিক গাড়িচালক ও প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারকেও মামলায় আসামি করা হয়েছে।
আনোয়ারা বেগমের আইনজীবীরা জানান, যাত্রাবাড়ী ও উত্তরা পূর্ব থানার মামলায় তিনি জামিন পেলেও মোহাম্মদপুর থানার মামলার শুনানির কারণে এখনও মুক্ত হতে পারছেন না। তাদের মতে, এসব মামলা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক। আদালতে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আনোয়ারা বেগমের সম্পৃক্ততা নেই উল্লেখ থাকলেও অন্য মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তার মুক্তির পথ আটকে রেখেছে।
এই গল্প কেবল আনোয়ারা বেগমের নয়, বরং আমাদের সমাজে সম্পত্তি দখলের জন্য কীভাবে রক্তের সম্পর্কও শত্রুতায় পরিণত হতে পারে তার একটি মর্মস্পর্শী উদাহরণ। একজন মা, যিনি সন্তানের জন্য জীবনের পর জীবন উৎসর্গ করেছেন, শেষ বয়সে সেই সন্তানের ষড়যন্ত্রেই কারাগারে বন্দি। তার জীবনের এই ট্র্যাজেডি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—সম্পদ যখন ভালোবাসা ও মানবিকতার জায়গা দখল করে নেয়, তখন সম্পর্কের সবচেয়ে দৃঢ় বন্ধনও ভেঙে পড়ে।
আপনার মতামত জানানঃ