বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলবদল নতুন কিছু নয়। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর অবস্থান বদলানোর ইতিহাস এ দেশে পুরোনো। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজ দল বিলুপ্ত করে কিংবা দল ছেড়ে বড় দলে যোগ দিয়ে এমপি হওয়ার প্রকাশ্য ও দ্রুতগতির যে প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, তা নতুন করে নৈতিকতা, আদর্শ ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিশেষ করে আগামী ১২ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই প্রবণতা যেভাবে সামনে এসেছে, তাতে রাজনীতিকে কেবল ক্ষমতা ও প্রতীকের অঙ্কে নামিয়ে আনার অভিযোগ আরও জোরালো হয়েছে।
অনেক রাজনীতিকের যুক্তি, বাংলাদেশের বাস্তবতায় নির্বাচন মানেই প্রতীক। যে প্রতীক শক্তিশালী, জয়ের সম্ভাবনাও সেখানে বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) সংশোধন এনে জোটভুক্ত হলেও নিবন্ধিত দলগুলোকে নিজ নিজ প্রতীকে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা তৈরি হওয়ায় ছোট ও মাঝারি দলগুলোর সামনে কার্যত দুইটি পথ খোলা রয়েছে—নিজস্ব প্রতীকে নিশ্চিত পরাজয়ের ঝুঁকি নেওয়া, অথবা দল বিলুপ্ত করে কিংবা দল ছেড়ে বড় দলে মিশে শক্তিশালী প্রতীকে নির্বাচন করা। অনেক নেতা দ্বিতীয় পথটিকেই বেছে নিচ্ছেন, আর এখানেই শুরু হচ্ছে বিতর্ক।
রাজনীতিতে নীতি ও আদর্শের প্রশ্নটি তাই আবার সামনে এসেছে। একটি দল গড়ে ওঠে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শন, কর্মসূচি ও সামাজিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে। সেই দল থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি হওয়ার মানে হলো ওই আদর্শ ও কর্মসূচির পক্ষে জনগণের রায় নিয়ে সংসদে যাওয়া। কিন্তু যখন একজন নেতা নির্বাচনের আগমুহূর্তে নিজের দল ভেঙে ফেলেন বা ছেড়ে দেন, তখন প্রশ্ন ওঠে—তিনি আসলে কোন আদর্শের প্রতিনিধি হয়ে সংসদে যেতে চান? নিজের দলের, নাকি যে দলে গিয়ে মনোনয়ন পেয়েছেন সেই দলের? নাকি আদৌ কোনো আদর্শ নয়, কেবল ব্যক্তিগত রাজনৈতিক টিকে থাকা ও ক্ষমতায় প্রবেশই মুখ্য?
অনেকে এটিকে সরাসরি অনৈতিক বলছেন। কারণ ভোটাররা যে দলের কর্মসূচি দেখে কাউকে সমর্থন করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত সেই ব্যক্তি অন্য প্রতীকে, অন্য পরিচয়ে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন। এতে ভোটারদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা ঘটে বলে সমালোচকদের দাবি। বিশেষ করে নতুন ও তরুণভিত্তিক দলগুলোর নেতাদের দল ছেড়ে বড় দলে যোগ দেওয়ার ঘটনা তরুণ রাজনীতিকদের মধ্যে হতাশা তৈরি করতে পারে। যারা রাজনীতিতে নতুন ধারার কথা বলছিলেন, তাদেরই যদি শেষ পর্যন্ত পুরোনো ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির আশ্রয় নিতে হয়, তাহলে পরিবর্তনের আশা কোথায়?
অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট নেতারা বিষয়টিকে দেখছেন বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। তাদের বক্তব্য, সংসদের বাইরে থেকে রাজনীতি করে আদর্শ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সংসদে যেতে হলে জিততে হবে, আর জয়ের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী প্রতীক ও সংগঠন। তারা বলছেন, এটি আদর্শ ত্যাগ নয়, বরং কৌশল। সংসদে ঢুকে তারা তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন। তাদের মতে, বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক বাস্তবতায় আদর্শ ও কৌশলের মধ্যে ভারসাম্য না রাখলে রাজনীতিতে টিকে থাকা কঠিন।
এই যুক্তির বিপরীতে বিশ্লেষকদের একটি বড় অংশ মনে করেন, কৌশলের নামে যে চর্চা চলছে, তা দীর্ঘমেয়াদে বহুদলীয় গণতন্ত্রকে দুর্বল করছে। ছোট দলগুলো যদি বারবার বড় দলের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তাহলে রাজনৈতিক বৈচিত্র্য কমে যাবে। সংসদে ভিন্ন মত ও ভিন্ন কণ্ঠস্বরের জায়গা সংকুচিত হবে। এতে রাজনীতি ধীরে ধীরে দুই বা এককেন্দ্রিক হয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। বহুদলীয় ব্যবস্থার মূল শক্তিই হলো বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী ও মতাদর্শের প্রতিনিধিত্ব, যা এই প্রবণতায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে দলবদল বিশেষ করে সামরিক শাসনামলে একটি পরিচিত দৃশ্য ছিল। ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে যে দল শক্তিশালী হতো, সেদিকেই ঝুঁকতেন অনেক রাজনীতিক। পরে গণতান্ত্রিক শাসনের বিভিন্ন পর্যায়েও জোট রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতার সমীকরণ বদলেছে। কিন্তু নির্বাচনের ঠিক আগে দল বিলুপ্ত করে বড় দলে মিশে যাওয়ার ঘটনা এবার যেভাবে প্রকাশ্যে ঘটছে, তা ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। এখানে জোটের শর্তে নিজস্ব পরিচয় বজায় রাখার চেষ্টাও নেই, বরং প্রতীক পাওয়ার জন্য নিজের রাজনৈতিক পরিচয় মুছে ফেলতেও অনেকে প্রস্তুত।
এর পেছনে এমপি হওয়ার আকর্ষণ বড় কারণ। বাংলাদেশের বাস্তবতায় একজন সংসদ সদস্য শুধু আইন প্রণেতাই নন, তিনি স্থানীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। উন্নয়ন প্রকল্প, প্রশাসনিক প্রভাব, সামাজিক প্রতিপত্তি—সব মিলিয়ে এমপি হওয়া মানেই ক্ষমতার এক বিশেষ অবস্থান। ফলে অনেক রাজনীতিকের কাছে এটি জীবনের একবারের সুযোগ হিসেবেও বিবেচিত হয়। বিশ্লেষকদের মতে, এই সুযোগ হাতছাড়া হলে ভবিষ্যতে আর নাও আসতে পারে—এই আশঙ্কাই অনেককে নীতি ও আদর্শের প্রশ্নকে গৌণ করে তুলতে বাধ্য করছে।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, এই কৌশল শেষ পর্যন্ত রাজনীতির জন্য কতটা ভালো? যদি এমপি হওয়ার একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়ায় বড় দলে মিশে যাওয়া, তাহলে ছোট দলগুলো টিকে থাকবে কীভাবে? নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান কীভাবে সম্ভব হবে? তরুণ প্রজন্ম যারা রাজনীতিতে নতুন চিন্তা ও সংস্কৃতির স্বপ্ন দেখছে, তারা কি এতে উৎসাহ পাবে, নাকি রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সহজ নয়, কিন্তু গুরুত্বের সঙ্গে ভাবার মতো।
নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। জোটভুক্ত দলগুলোর জন্য নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য হয়তো ছিল শৃঙ্খলা আনা ও প্রতীক ব্যবস্থাকে স্পষ্ট করা। কিন্তু এর অনাকাঙ্ক্ষিত ফল হিসেবে যদি দল বিলুপ্তি ও ব্যাপক দলবদল দেখা দেয়, তাহলে নীতিগত পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। আগের মতো জোটের প্রধান দলের প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ থাকলে হয়তো এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না—এমন মতও জোরালো হচ্ছে।
সব মিলিয়ে, নিজ দল ছেড়ে এমপি হওয়ার মরিয়া চেষ্টা নৈতিক কি না—এই প্রশ্নের উত্তর একমাত্রিক নয়। এটি একদিকে ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বাস্তবতার গল্প, অন্যদিকে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়। কেউ এটিকে কৌশল বলছেন, কেউ বলছেন আদর্শহীনতা। সত্য সম্ভবত এই দুইয়ের মাঝামাঝি কোথাও। তবে এটুকু স্পষ্ট, এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতি আরও বেশি প্রতীকনির্ভর ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে উঠবে, যেখানে আদর্শ ও নীতির জায়গা ক্রমেই সংকুচিত হবে।
শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত দেবেন ভোটাররাই। তারা দেখবেন কে কোন পথে এসে তাদের প্রতিনিধিত্ব করতে চাইছেন, এবং সেই পথ কতটা বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু ভোটারদের সামনে সত্যিকারের বিকল্প রাখার দায়িত্বও রাজনৈতিক ব্যবস্থার। সেই দায়িত্ব যদি দলবদল ও বিলুপ্তির হিড়িকে হারিয়ে যায়, তাহলে প্রশ্ন উঠবে শুধু ব্যক্তিগত নৈতিকতা নয়, পুরো রাজনৈতিক সংস্কৃতির নৈতিকতা নিয়েই।
আপনার মতামত জানানঃ