৫ আগস্ট ২০২৫, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে এক অনন্য মুহূর্তের সাক্ষী হলো জাতি। ইতিহাসের এক মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া দিনটির প্রথম বার্ষিকীতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস উচ্চ কণ্ঠে পাঠ করলেন “জুলাই ঘোষণাপত্র”। জনতার সামনে প্রথমবারের মতো পাঠ করা এই দলিল শুধু একটি রাজনৈতিক ঘোষণাই নয়—এ যেন বাংলাদেশের বহু দশকের বিক্ষুব্ধ ইতিহাস, সংগ্রামের বেদনাবিধুর দলিল, এবং একটি নতুন শুরুতে উত্তরণের দৃঢ় অঙ্গীকার।
এই ঘোষণাপত্রে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে স্বাধীনতার পরবর্তী প্রতিটি ব্যর্থতা, প্রতারণা ও ফ্যাসিবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে জনতার লালিত ক্ষোভ ও বিক্ষোভের বিবরণ। একে শুধু ঘোষণাপত্র বলা ভুল হবে—এ যেন গণ-অভ্যুত্থানের পর জন্ম নেওয়া এক নতুন জাতির আত্মপ্রকাশ, যেখানে বঞ্চনার ইতিহাসকে দলিল করে ভবিষ্যতের পথরেখা আঁকা হয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া দীর্ঘ একচ্ছত্র ক্ষমতা ও স্বৈরশাসনের অধ্যায়ের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটেছে, আর সেই সমাপ্তিকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে ঘোষণাপত্রটি জানিয়ে দিল—এবার ইতিহাস রচনা করবে জনতা।
চলুন জেনে নেওয়া যাক কী আছে এই ঘোষণাপত্রে
১। যেহেতু, উপনিবেশবিরোধী দীর্ঘ লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় এই ভূখণ্ডের মানুষ পাকিস্তানের ২৩ বছরের স্বৈরশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল;
২। যেহেতু, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনগণ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে;
৩। যেহেতু, স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন পদ্ধতি ও কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয় এবং গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা ব্যাহত হয়;
৪। যেহেতু, আওয়ামী লীগ সরকার একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা চালু করে মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করে, যার প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং পরবর্তীকালে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়;
৫। যেহেতু, আশির দশকে সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার নয় বছরের লড়াইয়ের মাধ্যমে ১৯৯০ সালের গণ–অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় এবং ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তিত হয়;
৬। যেহেতু, দেশি–বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে ১/১১-এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র আধিপত্য ও ফ্যাসিবাদী শাসনের ভিত্তি গড়ে তোলা হয়;
৭। যেহেতু, গত ১৬ বছরে সংবিধানের অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক পরিবর্তনের মাধ্যমে একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার পথ সুগম করে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে;
৮। যেহেতু, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে ধ্বংস করা হয়েছে;
৯। যেহেতু, তার শাসনামলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে একটি ফ্যাসিস্ট, মাফিয়া ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়;
১০। যেহেতু, তথাকথিত উন্নয়নের আড়ালে দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার ও প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ ও জলবায়ু বিপর্যস্ত করা হয়েছে;
১১। যেহেতু, ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে গত ১৬ বছর ধরে জনগণ, রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠন নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে জেল-জুলুম, হামলা-মামলা ও হত্যা সহ্য করেছে;
১২। যেহেতু, বিদেশি শক্তির শোষণ ও খবরদারির বিরুদ্ধে মানুষের ন্যায্য আন্দোলনকে আওয়ামী লীগ সরকার দমন করেছে;
১৩। যেহেতু, সরকার ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার হরণ করে ক্ষমতা দখল করে রাখে;
১৪। যেহেতু, ভিন্নমতের ছাত্র, তরুণ, চাকরি প্রার্থীদের ওপর দমন-পীড়ন, দলীয় নিয়োগ ও কোটাভিত্তিক বৈষম্য জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ও বিক্ষোভ সৃষ্টি করে;
১৫। যেহেতু, বিরোধী দল ও সংগঠনের ওপর নিপীড়নের ফলে জনরোষ বৃদ্ধি পায় এবং জনগণ সকল গণতান্ত্রিক উপায়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই চালিয়ে যায়;
১৬। যেহেতু, সরকারি চাকরিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ সরকার বর্বর দমন-পীড়ন, হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ চালায়, যা গণ–অভ্যুত্থানে রূপ নেয়;
১৭। যেহেতু, এই অভ্যুত্থানে সমাজের সব স্তরের মানুষ যুক্ত হয় এবং আওয়ামী বাহিনী প্রায় এক হাজার মানুষকে হত্যা ও অগণিত মানুষকে পঙ্গু করে ফেলে; শেষপর্যায়ে সেনাবাহিনী আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায়;
১৮। যেহেতু, ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে জনগণের গণভবন অভিমুখী পদযাত্রার মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগে বাধ্য হয়ে দেশত্যাগ করেন;
১৯। যেহেতু, গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রকাশ এবং বাস্তবায়ন রাজনৈতিক ও আইনি দিক থেকে বৈধ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত;
২০। যেহেতু, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বাতিল করে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়;
২১। যেহেতু, জনগণ ফ্যাসিবাদ, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে;
২২। সেহেতু, জনগণ আইনের শাসন, সুশাসন, সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক রূপান্তর চায়;
২৩। সেহেতু, জনগণ গুম-খুন, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুণ্ঠনের দ্রুত বিচার দাবি করছে;
২৪। সেহেতু, জনগণ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের জাতীয় বীর ঘোষণা ও আহত আন্দোলনকারীদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করার প্রত্যয় জানায়;
২৫। সেহেতু, একটি অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে মানবাধিকারসম্পন্ন, মূল্যবোধভিত্তিক, বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের অভিপ্রায় জনগণ ব্যক্ত করছে;
২৬। সেহেতু, জনগণ পরিবেশ ও জলবায়ু-সহনশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়ন কৌশলের মাধ্যমে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার রক্ষার প্রত্যাশা করছে;
২৭। জনগণ এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করছে যে, ছাত্র-গণ–অভ্যুত্থান ২০২৪-এর উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হবে এবং ঘোষণাপত্রটি পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদের সংস্কারকৃত সংবিধানে সংযোজন করা হবে;
২৮। ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে গণ-অভ্যুত্থানে বিজয়ী জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে এই “জুলাই ঘোষণাপত্র” প্রণয়ন করা হলো।
আপনার মতামত জানানঃ