সতেরো বছর পর তারেক রহমানের দেশে ফেরা শুধু একজন রাজনীতিকের প্রত্যাবর্তন নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। দীর্ঘ নির্বাসন, কারাবাসের স্মৃতি, বিতর্ক, সমর্থকদের প্রত্যাশা আর সমালোচকদের প্রশ্ন—সব মিলিয়ে তার এই ফিরে আসা ব্যক্তি তারেক রহমানের পাশাপাশি বিএনপি এবং সামগ্রিক রাজনৈতিক বাস্তবতার জন্যও বড় পরীক্ষা। যে মুহূর্তে তিনি দেশে ফিরেছেন, সে সময়টা এমনিতেই অস্থির, নির্বাচনকেন্দ্রিক উত্তেজনায় ভরা এবং নানা অনিশ্চয়তায় ঘেরা।
২০০৭ সালে সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে আঠারো মাস কারাবাস এবং এরপর যুক্তরাজ্যে দীর্ঘ সময় অবস্থান—এই অধ্যায় তারেক রহমানের রাজনৈতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। এতদিন বিদেশে থাকার কারণে তার অনুপস্থিতি যেমন দলীয় নেতৃত্বে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি করেছিল, তেমনি দেশে ফেরার প্রশ্নে সময়ের ব্যবধান নানা জল্পনা-কল্পনাও জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার অসুস্থতার সময় তার দেশে না ফেরা নিয়ে যে সমালোচনা হয়েছে, তা এখনও পুরোপুরি স্তিমিত হয়নি। এসব প্রশ্ন তার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির সঙ্গেই জড়িয়ে গেছে।
ঢাকায় ফেরার দিন বিমানবন্দর থেকে শুরু করে সংবর্ধনাস্থল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের বিপুল উপস্থিতি দেখিয়েছে যে দলের ভেতরে তার প্রতি আগ্রহ ও প্রত্যাশা কতটা গভীর। তবে এই সমর্থনই আবার বড় চাপ তৈরি করছে। একজন নেতা হিসেবে তারেক রহমানকে শুধু আবেগ বা স্মৃতির ওপর ভর করে এগোনো যাবে না; তাকে দেখাতে হবে বাস্তব রাজনৈতিক সক্ষমতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের দৃঢ়তা এবং স্বচ্ছতা। দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে থাকার ফলে দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন করে মানিয়ে নেওয়াটাও তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
নিরাপত্তার প্রশ্ন তার ব্যক্তিগত জীবনের একটি বড় বাস্তবতা। অতীতে তার ওপর হামলার আশঙ্কা এবং রাজনৈতিক সহিংসতার ইতিহাস বিবেচনায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্বাভাবিক। কিন্তু এই নিরাপত্তা ব্যবস্থাই জনসংযোগে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। একজন রাজনৈতিক নেতার জন্য জনগণের কাছাকাছি থাকা গুরুত্বপূর্ণ, আর অতিরিক্ত নিরাপত্তা সেই স্বাভাবিক যোগাযোগে দূরত্ব তৈরি করতে পারে। তিনি কীভাবে এই ভারসাম্য রক্ষা করবেন, সেটি ভবিষ্যতে তার রাজনৈতিক কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে উঠবে।
তারেক রহমানকে ঘিরে আরেকটি বড় প্রশ্ন তার দীর্ঘ বিদেশবাস এবং সেখানে তার অবস্থানসংক্রান্ত স্বচ্ছতা। পাসপোর্ট, ট্রাভেল পাস, নাগরিকত্ব, আয়ের উৎস—এসব বিষয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। বিএনপি নেতারা বারবার আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেও জনমনে তৈরি হওয়া সংশয় পুরোপুরি দূর হয়নি। রাজনীতিতে বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক সময় আইনি বা আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যার চেয়েও বড় হয়ে ওঠে, আর এই বিশ্বাসযোগ্যতা ফেরাতে হলে তাকে আরও স্পষ্ট ও ধারাবাহিক অবস্থান নিতে হতে পারে।
ব্যক্তিগত প্রশ্নের পাশাপাশি রাজনৈতিক লিগ্যাসিও তার জন্য বড় বোঝা। ২০০১–২০০৬ মেয়াদে বিএনপি সরকারের সময় তারেক রহমানকে ঘিরে ‘হাওয়া ভবন’সহ নানা অভিযোগ এখনো মানুষের স্মৃতিতে রয়ে গেছে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, বিএনপি যদি শুধু সেই অতীত সাফল্য বা আবেগের ওপর ভর করে এগোতে চায়, তাহলে তা হবে ঝুঁকিপূর্ণ। তারেক রহমানের সামনে তাই বড় চ্যালেঞ্জ হলো অতীতের সেই ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে নতুন রাজনৈতিক ভাষ্য ও ভিন্ন নেতৃত্বের ধরন উপস্থাপন করা।
রাজনৈতিক দিক থেকে তার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা আসন্ন জাতীয় নির্বাচন। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বা দুর্বল অবস্থানে বিএনপির ওপর মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। একটি বড় মধ্যপন্থি গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে বিএনপি কীভাবে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবে, সেটির নেতৃত্ব তারেক রহমানকেই দিতে হবে। নির্বাচন ঘিরে কৌশল নির্ধারণ, বিরোধী সমালোচনার জবাব, কূটনৈতিক চাপ মোকাবিলা এবং অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ সামাল দেওয়া—সবই তার সামনে একসঙ্গে হাজির।
দলের ভেতরের পরিস্থিতিও সহজ নয়। গত দেড় বছরে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজি এবং সহিংসতার অভিযোগ দলটির ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
আইন ও সালিস কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে বহু প্রাণহানি ও আহতের ঘটনা ঘটেছে, যা একটি বড় রাজনৈতিক দলের জন্য উদ্বেগজনক। তারেক রহমান নিজেই হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন, যা একদিকে কঠোর অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়, অন্যদিকে মাঠপর্যায়ে ঐক্য ধরে রাখার চ্যালেঞ্জও বাড়িয়ে দেয়।
দলের শৃঙ্খলা ফেরানো, চাঁদাবাজি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দমন করা শুধু ঘোষণার মাধ্যমে সম্ভব নয়। মাঠপর্যায়ে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ, বিশ্বাসযোগ্য শাস্তি ও ন্যায্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করতে না পারলে এসব সমস্যা আবারও মাথাচাড়া দিতে পারে। তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি আদৌ এই পরিবর্তন আনতে পারবে কি না, তা নিয়েই এখন নজর বিশ্লেষকদের।
আরেকটি জটিলতা হলো নেতাকর্মীদের প্রত্যাশা সামাল দেওয়া। দীর্ঘদিন লন্ডনে থাকা ঘনিষ্ঠ নেতারা এবং দেশে আন্দোলন–সংগ্রামে সক্রিয় থাকা নেতাদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা সহজ কাজ নয়। নির্বাচনী মনোনয়নকে কেন্দ্র করে ক্ষোভ, বঞ্চনার অভিযোগ এবং অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা বাড়তে পারে। যেসব নেতাকর্মী আওয়ামী লীগ শাসনামলে দেশে থেকে নির্যাতন ও হয়রানির মুখোমুখি হয়েছেন, তারা নিজেদের অবদান অনুযায়ী স্বীকৃতি চান। এই প্রত্যাশা পূরণ না হলে দলীয় ঐক্য দুর্বল হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকার কারণে বাস্তব মাঠরাজনীতির অভিজ্ঞতার ঘাটতিও তারেক রহমানের জন্য একটি বাস্তব সমস্যা। ভার্চুয়াল যোগাযোগের মাধ্যমে নেতৃত্ব দেওয়া আর সরাসরি মাঠে নেমে মানুষের সঙ্গে মেশা—এই দুইয়ের মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে। দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, প্রশাসনের ভূমিকা, স্থানীয় ক্ষমতার কাঠামো—এসব বিষয় সরাসরি না দেখলে অনেক সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ভুল হতে পারে। এই ‘গ্রাউন্ড রিয়েলিটি’ বোঝার জন্য তাকে সময় ও ধৈর্য দেখাতে হবে।
এদিকে নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা, ষড়যন্ত্র ও অনিরাপত্তার আশঙ্কাও রয়েছে। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নির্বাচন যত কাছে আসে, ততই রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ে। বিএনপি জয়ী হতে পারে—এমন ধারণা থেকে ব্যবসায়ী, সিভিল সোসাইটি বা প্রশাসনের কিছু অংশের ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনাও আলোচনায় এসেছে। এসব পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে দলের ভাবমূর্তি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
সব মিলিয়ে তারেক রহমানের সামনে চ্যালেঞ্জের তালিকা দীর্ঘ। ব্যক্তি হিসেবে তাকে নিজের অতীত, অনুপস্থিতি ও বিতর্কের ব্যাখ্যা দিতে হবে; রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তাকে একটি বড় দলের শৃঙ্খলা, ঐক্য ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নিশ্চিত করতে হবে। তার দেশে ফেরা নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা তৈরি করেছে ঠিকই, কিন্তু সেই উদ্দীপনাকে টেকসই রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তর করাই হবে তার প্রকৃত পরীক্ষা।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটি একটাই—সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তিনি কি জনগণের আস্থা ফেরাতে পারবেন? উত্তরটি নির্ভর করবে তার নেতৃত্বের ধরন, সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতা, দলের ভেতরের সংস্কার এবং দেশের মানুষের প্রত্যাশা কতটা বাস্তবভাবে পূরণ করতে পারেন তার ওপর। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার এই প্রত্যাবর্তন তাই শুধু একটি অধ্যায়ের সূচনা নয়, বরং একটি দীর্ঘ ও কঠিন পরীক্ষার শুরু।
আপনার মতামত জানানঃ