
বাঙালি সমাজে বোরকা এখন এক পরিচিত পোশাক, প্রায় প্রতিদিনের জীবনের অংশ। কিন্তু সব সময় এমন ছিল না। একসময় এই পোশাকের অস্তিত্বই ছিল সীমিত, আবার কখনও ছিল বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। বোরকার ইতিহাস আসলে ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজ পরিবর্তনের ইতিহাসও বটে। এটি শুধু একটি পোশাক নয়, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি মুসলমান সমাজের আত্মপরিচয়, শালীনতা ও ধর্মীয় চর্চার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
বাংলার মুসলমান সমাজের গঠনই শুরু হয় বহিরাগত প্রভাবের মধ্য দিয়ে। দ্বাদশ শতাব্দীর দিকে তুর্কি ও আফগান মুসলমানরা বাংলা অঞ্চলে আসেন প্রশাসন ও সামরিক কারণে। তারা নিয়ে আসেন ইসলামী সংস্কৃতি, আচার এবং পোশাকের ধারা। তবে সে সময়কার বাঙালি মুসলমানদের জীবনযাত্রা ছিল মূলত গ্রামীণ ও কৃষিনির্ভর, যেখানে নারীরা গৃহস্থালির পাশাপাশি কৃষিকাজেও যুক্ত ছিলেন। তাই তাদের পোশাকও ছিল সহজ, আরামদায়ক ও কাজের উপযোগী—সাধারণত শাড়ি, ওড়না বা কাপড়ের পর্দা। বোরকা তখনও সমাজে প্রচলিত হয়নি।
মোগল আমলে ইসলামি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে নতুন আকারে। রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে মুসলমান অভিজাত শ্রেণি তৈরি হয়, যারা দিল্লি ও লখনৌর আভিজাত্যের প্রভাব গ্রহণ করে। তাদের নারীরা পর্দাপ্রথা মেনে চলতেন। তখন ‘চাদর’ বা ‘বড় ওড়না’ ব্যবহার করতেন গৃহবন্দি নারীরা। তবে আজকের মতো সেলাই করা বোরকা বা নেকাব তখনও সাধারণ ছিল না। অনেকেই মুখ ঢাকতে ঘোমটা টানতেন, আবার কেউ কেউ বাড়ির বাইরে গেলে পাতলা পর্দার কাপড় ব্যবহার করতেন। গ্রামীণ মুসলমান নারীরা তখনও শাড়িই পরতেন, এবং বোরকা তাদের জীবনে ঢুকতে অনেক দেরি হয়।
ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে পরিবর্তন আসে। শিক্ষার প্রসার, নগরায়ণ ও সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে মুসলমান সমাজও নতুন ধারা গ্রহণ করতে শুরু করে। কিন্তু সেই সময়েই বাঙালি মুসলমান সমাজে নারী শিক্ষা ও পর্দা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। নবজাগরণের প্রভাবে হিন্দু সমাজে নারীর মুক্তির কথা উঠলেও, মুসলমান সমাজে তখনও “পর্দা রক্ষা” ছিল ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত। ইংরেজ শাসনের সময়ে অনেক মুসলমান পরিবার তাদের মেয়েদের বাইরে পাঠাতে শুরু করে, কিন্তু পর্দা বজায় রাখার জন্য তাদের বোরকা পরতে বলা হয়। সেই সময় থেকেই ধীরে ধীরে বোরকা বাঙালি মুসলমান নারীর পোশাকে জায়গা পেতে শুরু করে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে শহুরে মুসলমান পরিবারে বোরকার প্রচলন বাড়ে। ১৯২০-এর দশক থেকে কলকাতা, ঢাকা ও চট্টগ্রামে মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠতে থাকে। তখন ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে আধুনিকতার এক অদ্ভুত মিশ্রণ তৈরি হয়। মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছেন, ডাক্তার দেখাতে বা আত্মীয়ের বাসায় বের হচ্ছেন, কিন্তু সমাজের চোখে শালীনতা বজায় রাখতে পরছেন কালো কাপড়ের তৈরি বোরকা। এই সময়েই “পর্দা” ও “বোরকা” শব্দ দুটি সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। বোরকা পরা মেয়েকে বলা হতো “ভালো ঘরের মেয়ে”, আর না পরলে অনেক জায়গায় তা অসম্মানের চোখে দেখা হতো।
পাকিস্তান আমলে বোরকার ব্যবহার আরও বাড়ে। পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান পরিচয় দৃঢ় করার প্রবণতা তৈরি হয়। বোরকা তখন কেবল শালীনতার নয়, ধর্মীয় পরিচয়েরও প্রতীক হয়ে ওঠে। শহরে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েদের মধ্যে তখনও শাড়ির ব্যবহার ছিল প্রচলিত, কিন্তু অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে বা অফিসে যাতায়াতের সময় বোরকা ব্যবহার করতেন। এটি এক ধরনের “সামাজিক সুরক্ষা” হিসেবেও কাজ করত, কারণ জনপরিসরে নারীর নিরাপত্তা তখনও দুর্বল ছিল।
তবে আশির দশকের দিকে দৃশ্যপট আরও বদলে যায়। মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে যাওয়া বাঙালি শ্রমিকদের সঙ্গে আরব সংস্কৃতি ও পোশাকের প্রভাব দেশে ফিরে আসে। গালফ দেশে যারা কাজ করতেন, তারা সেখানে বোরকা ও নেকাব পরা নারীদের জীবনধারা দেখে অনুপ্রাণিত হন। তাদের পরিবারগুলোতে, বিশেষ করে গ্রামীণ ও শহরতলির মুসলমান সমাজে, বোরকা এক ধর্মীয় অনুশাসনের পোশাক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। তখন থেকেই বাজারে তৈরি বোরকার ব্যবসা বেড়ে যায়, এবং সেলাই করা কালো পোশাকটি ক্রমে সাধারণ হয়ে ওঠে।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দুই দশকে বোরকা ছিল একান্তই ধর্মীয় ও পারিবারিক সিদ্ধান্তের বিষয়। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে মিডিয়া, মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার, এবং রাজনৈতিক ইসলামি দলগুলোর কার্যক্রমের ফলে বোরকা পরার সংস্কৃতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। টেলিভিশনে ইসলামিক অনুষ্ঠান, ধর্মীয় বক্তাদের জনপ্রিয়তা এবং সামাজিক প্রভাব বোরকাকে “ধর্মভীরুতা”র প্রতীক করে তোলে। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে নারী কর্মসংস্থান ও শিক্ষায় অংশগ্রহণ। নারীরা বাইরে বেরোচ্ছেন, অফিসে যাচ্ছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন—তাদের জন্য বোরকা হয়ে ওঠে নিরাপত্তা ও শালীনতার প্রতীক। সমাজও তা সহজভাবে গ্রহণ করে নেয়।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে বোরকা আর শুধু ধর্মীয় পোশাক নয়, এটি এখন একধরনের ফ্যাশনও। বাজারে নানা রকম রঙ, ডিজাইন ও কাপড়ের বোরকা পাওয়া যায়। কেউ হালকা রঙের হিজাব পরে, কেউ কালো বোরকার সঙ্গে ফুলেল ডিজাইন যোগ করে। কেউ একে আধুনিক পোশাকের মতো ব্যবহার করছে, আবার কেউ একে ধর্মীয় দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে পরছে। এই পরিবর্তন প্রমাণ করে, বোরকা এখন বাঙালি মুসলমান নারীর সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে, তবে তার অর্থ সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে।
অন্যদিকে, বোরকা নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। কেউ বলেন, এটি নারীর স্বাধীনতার বাধা; আবার কেউ বলেন, এটি নারীর নিজের সিদ্ধান্ত। পশ্চিমা দৃষ্টিতে বোরকা কখনো নিপীড়নের প্রতীক, কখনো পরিচয় রক্ষার হাতিয়ার। কিন্তু বাঙালি সমাজে বোরকা একেবারে আলাদা অর্থ বহন করে। এখানে এটি শালীনতা, পারিবারিক মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় শ্রদ্ধার সঙ্গে জড়িত। এক তরুণী হয়তো অফিসে যাচ্ছে বোরকা পরে, কিন্তু অফিসে গিয়ে শাড়ি পরে কাজ করছে—এখানে বোরকা তার জন্য ধর্ম নয়, বরং সুরক্ষার আবরণ।
আধুনিক বাঙালি মুসলমান সমাজে বোরকার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। এখন অনেক নারী বলেন, “আমি বোরকা পরি কারণ আমি চাই, কেউ চাপ দেয় না।” আবার কেউ বলেন, “এতে আমি নিরাপদ বোধ করি।” এই ব্যক্তিগত অনুভূতিই প্রমাণ করে যে বোরকা আজ একটি ব্যক্তিগত ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি হয়ে উঠেছে। কেউ হয়তো ধর্মীয় কারণে পরছেন, কেউ সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য, আবার কেউ একে নিজের পরিচয়ের অংশ মনে করেন।
তবে এ-ও সত্য, সমাজে বোরকা এখনো নারী-পুরুষের অসমতা ও ধর্মীয় ব্যাখ্যার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কেউ মনে করেন, এটি ধর্মীয় চেতনার জাগরণ; কেউ বলেন, এটি নারীকে ঘরে রাখার কৌশল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের সমাজে বোরকা এখন এতটাই মিশে গেছে যে এটি ছাড়া মুসলিম নারীর পোশাকের আলোচনা অসম্পূর্ণ। শহর থেকে গ্রাম, অফিস থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—সব জায়গাতেই এর উপস্থিতি দেখা যায়।
বোরকার এই যাত্রাপথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এর অভিযোজন। এটি কখনো আরবের পোশাক, কখনো পারস্যের প্রভাব, আবার কখনো বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির রূপ নিয়েছে। যেমন গ্রামে এখনও অনেক নারী শাড়ির ওপর ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকেন, কিন্তু তাতেও আছে একই ধর্মীয় অর্থ। তাই বোরকা এখন আর কেবল কালো কাপড় নয়, এটি বাঙালি মুসলমান নারীর ইতিহাসের প্রতীক—যেখানে ধর্ম, সমাজ, লজ্জা, নিরাপত্তা ও ফ্যাশন মিলেমিশে গেছে।
আজকের বাংলাদেশে বোরকা মানে কেবল পর্দা নয়, এটি এক সামাজিক ভাষা। এর ভেতর লুকিয়ে আছে বিশ্বাস, আত্মসম্মান, কখনো ভয়, কখনো প্রতিবাদও। কেউ বোরকা পরে নিজেকে রক্ষা করে, কেউ নিজের ধর্মীয় পরিচয় জানান দেয়, আবার কেউ সমাজের চোখে গ্রহণযোগ্য থাকতে চায়। কিন্তু সব মিলিয়ে বোরকা এখন এমন এক সাংস্কৃতিক প্রতীক, যা বাংলার মুসলমান সমাজকে বোঝার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ইতিহাসের ধারায় দেখা যায়, কোনো সংস্কৃতি একদিনে তৈরি হয় না। বোরকার এই দীর্ঘ পথচলা—মোগল দরবার থেকে শুরু করে ঢাকার গুলশানের রাস্তায়, কিংবা গ্রামের মসজিদের আঙিনা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস পর্যন্ত—এটি আসলে এক সমাজের বিবর্তনের প্রতিফলন। বোরকা বাঙালি মুসলমান নারীর জীবনে এসেছে ধর্ম থেকে, কিন্তু টিকে আছে সমাজ ও সংস্কৃতির মিশ্রণে। সময়ের সঙ্গে এর রূপ বদলেছে, অর্থ বদলেছে, কিন্তু এর অবস্থান আজ অটল।
বাঙালি মুসলমানের জীবনে বোরকা এখন এক চিরচেনা বাস্তবতা। কেউ ভালোবাসে, কেউ প্রশ্ন তোলে, কিন্তু কেউই একে উপেক্ষা করতে পারে না। কারণ বোরকা এখন শুধু পোশাক নয়, এটি ইতিহাসের পরিধেয় এক প্রতীক, যা এক সমাজের পরিচয় ও সময়ের গল্প বলে।
আপনার মতামত জানানঃ