
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়টিকে অনেকেই উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির স্বর্ণযুগ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সংখ্যার পেছনের বাস্তবতাটি কতটা টেকসই, কতটা প্রতারণামূলক—এ প্রশ্নটাই এখন নতুন করে উঠে আসছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর একাধিক গবেষক, অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা যে চিত্র তুলে ধরছেন, তা উন্নয়নের প্রচলিত ধারণাকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলামের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ সেই প্রশ্নটিকেই সামনে এনেছে—বাংলাদেশ কি প্রকৃত উন্নয়ন অর্জন করেছিল, নাকি ঋণের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে কৃত্রিম প্রবৃদ্ধির কাহিনি রচনা করেছিল?
লেখায় উপস্থাপিত তথ্য বলছে, ২০০৯ সালে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের আগস্টে সেটি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকায়। এই সময়ের মধ্যে ঋণ বেড়েছে ১৫ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকা—যা প্রায় সাতগুণ। এমন ঋণবৃদ্ধি কোনো দেশের পুঁজিনির্ভর উন্নয়ন প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক চিত্র নয়, বরং একটি বিপুল পরিমাণ দায়ের বোঝা, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। ড. ইসলাম এই পরিস্থিতিকে বর্ণনা করেছেন “ঋণ করে ঘি খাওয়া” উন্নয়নের উদাহরণ হিসেবে।
এই বিশাল ঋণের বিপরীতে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন দেখানো হয়েছে, সেটি বাস্তবে কতটা উৎপাদনশীল বিনিয়োগে পরিণত হয়েছে, তা নিয়েই প্রশ্ন। প্রাক্তন সরকারের সময়ে যেসব মেগা প্রকল্প গৃহীত হয়েছিল—পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর—এসব প্রকল্প অর্থনীতিকে প্রাথমিকভাবে চাঙ্গা করলেও এর ব্যয় ছিল অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ওঠা। সরকারি নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী অনেক প্রকল্পে প্রকৃত ব্যয়ের তিন থেকে চারগুণ বেশি হিসাব দেখানো হয়েছে। এর মানে, “উন্নয়ন” নামের ব্যানারে এক মহা লুণ্ঠনের উৎসব চলেছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বেসরকারি স্বার্থে সরে গেছে।
দীর্ঘ মেয়াদে এই অতিরিক্ত ঋণ ও দুর্নীতির সংমিশ্রণ অর্থনীতিতে যে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে, তার প্রভাব আজ দেখা যাচ্ছে ব্যাংকিং খাতে। ব্যাংকগুলো একদিকে খেলাপি ঋণের ভারে নুয়ে পড়েছে, অন্যদিকে আমানতকারীদের আস্থা কমে গেছে। আইএমএফের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নন-পরফর্মিং লোনের হার আনুষ্ঠানিকভাবে ১০ শতাংশ, কিন্তু প্রকৃত হার ২০ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ প্রতি পাঁচ টাকার একটিই আদায়যোগ্য নয়। ড. ইসলামের মতে, এই চিত্র তৈরি হয়েছে কারণ রাষ্ট্র নিজেই দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে—সরকার, দলীয় ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের এক অদৃশ্য ত্রিভুজে সম্পদ বণ্টনের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে।
বিদেশে পুঁজি পাচারের প্রশ্নটি এই বিশ্লেষণের কেন্দ্রবিন্দু। টিআইবি ও বিভিন্ন স্বাধীন গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে প্রতি বছর গড়ে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে; মোট অঙ্ক দাঁড়ায় প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার। এই অর্থের সিংহভাগ গিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে। এটি কেবল অর্থনৈতিক অপরাধ নয়; এটি উন্নয়নের গতিপথ থেকে উৎপাদনশীল মূলধনকে সরিয়ে নিয়ে যায়। দেশীয় শিল্প, কৃষি ও প্রযুক্তি-বিনিয়োগে এই পুঁজি ব্যবহার হলে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির প্রকৃত ভিত্তি গড়ে উঠতে পারত।
তথ্য বিকৃতির প্রসঙ্গও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতায় “ডেটা ডক্টরিং” বা তথ্য-কারসাজির অভিযোগ বহুদিনের। প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে দেখানো, দারিদ্র্য কমিয়ে দেখানো, মূল্যস্ফীতি কম দেখানো—এসবই উন্নয়নের সাফল্য প্রদর্শনের রাজনীতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এতে করে সরকারের প্রতি আস্থা নষ্ট হয়েছে, একই সঙ্গে নীতিনির্ধারণে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। যখন বাস্তবতা লুকোনো হয়, তখন সমস্যার প্রকৃত সমাধানও অধরা থেকে যায়।
ড. ইসলাম যেভাবে দেখিয়েছেন, হাসিনা সরকারের উন্নয়ন মডেল ছিল রাষ্ট্রীয় ঋণ-নির্ভর ব্যয়বিস্তার। এই ব্যয় বৃদ্ধি শুরুতে অবকাঠামোগত চাহিদা মেটাতে সাহায্য করলেও, উৎপাদন খাতে কোনো সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রবৃদ্ধি ঘটেনি। ফলে ঋণ-চালিত প্রবৃদ্ধি অল্প সময়ের মধ্যেই মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি ও ঋণ-সেবার চাপ তৈরি করেছে। অর্থনীতির মৌলিক সূচকগুলো—রপ্তানি, রিজার্ভ, বাজেট ঘাটতি, শিল্পোৎপাদন—সব ক্ষেত্রেই ধস নেমেছে।
অর্থনৈতিক এই পতনের আরেকটি দিক হলো “উন্নয়ন-রাজনীতি”। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে উন্নয়ন কথাটি পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক বৈধতা অর্জনের প্রধান অস্ত্রে। সরকারের সাফল্য প্রমাণ করতে হলে নতুন সেতু, ফ্লাইওভার বা মেট্রোরেল উদ্বোধনই যথেষ্ট বলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এই মানসিকতার কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠি হয়েছে কংক্রিট ও বিটুমিনের পরিমাণ, মানুষের জীবনমান বা সামাজিক ন্যায্যতার উন্নতি নয়। যখন উন্নয়নকে রাজনৈতিক প্রচারের উপকরণ বানানো হয়, তখন তা প্রকৃত অর্থে টেকসই থাকে না।
এই বাস্তবতায় অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে এক বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার চ্যালেঞ্জে। ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, পুঁজিপাচার রোধ, এবং আন্তর্জাতিক আস্থার পুনর্গঠন—সবকিছু একসাথে করতে হচ্ছে। প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরতা আবারও বেড়েছে, কিন্তু রপ্তানি আয় হ্রাস এবং বিনিয়োগে স্থবিরতা অব্যাহত রয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশে নেমে আসবে—যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এই প্রেক্ষাপটে বিদেশি গবেষণা সংস্থাগুলোর পর্যবেক্ষণ নতুন মাত্রা যোগ করেছে। একাধিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রকৃত জিডিপি ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি নয় এবং মাথাপিছু আয় ১৭৯৪ ডলার। অথচ আগের সরকার দাবি করত ৪৫০ বিলিয়ন ডলার জিডিপি ও মাথাপিছু আয় ২,৮০০ ডলার। এই ব্যবধান কেবল সংখ্যাগত নয়; এটি একটি বিশ্বাসের সংকট। জনগণ এখন প্রশ্ন করছে—এত “অগ্রগতি” কোথায় গেল? কেন বাজারে দ্রব্যমূল্য অস্থিতিশীল, কেন চাকরির বাজারে মন্দা, কেন বৈদেশিক রিজার্ভে ঘাটতি?
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন দাঁড়িয়ে আছে এক সংকটময় সন্ধিক্ষণে। ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধের দায় আগামী এক দশক পর্যন্ত অর্থনীতির বড় অংশ গ্রাস করবে। রাজস্ব ঘাটতি পূরণে কর বাড়ানোর চাপ জনগণের ওপর পড়বে। অন্যদিকে নতুন উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হলে তা আবারও ঋণ নির্ভর হয়ে পড়বে। এই চক্র থেকে বের হতে হলে প্রয়োজন গভীর কাঠামোগত সংস্কার—ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা, রাজস্ব প্রশাসনের আধুনিকীকরণ, এবং সরকারি ব্যয়ের জবাবদিহিতা।
ড. ইসলামের বিশ্লেষণের মূল বার্তা হচ্ছে—উন্নয়ন মানে শুধু পরিকাঠামো নয়; এটি মানসিকতা ও নৈতিকতার প্রশ্ন। একটি রাষ্ট্র তখনই উন্নত হয় যখন তার নাগরিকরা নিরাপদ, ন্যায্য ও সম্মানজনক জীবনযাপনের সুযোগ পায়। ঋণনির্ভর প্রবৃদ্ধি সেই সুযোগ দেয় না; বরং জনগণের ভবিষ্যৎকে বন্ধক রাখে। তাই আজ প্রয়োজন স্বচ্ছ নীতিনির্ধারণ, সুশাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা।
তবে আশার আলোও আছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অর্থনৈতিক নীতিতে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে—ব্যাংক সংস্কার, প্রবাসী আয়ের প্রণোদনা, এবং দুর্নীতিবিরোধী উদ্যোগ। এসব কার্যকর হলে অর্থনীতি ধীরে ধীরে আস্থা ফিরে পেতে পারে। কিন্তু এর জন্য দরকার রাজনৈতিক ঐকমত্য, কারণ কোনো অর্থনৈতিক সংস্কারই টেকসই হয় না যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকে।
সবশেষে বলা যায়, ড. মইনুল ইসলামের কলাম কেবল একটি অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ নয়; এটি এক আত্মসমালোচনার আহ্বান। রাষ্ট্র যদি উন্নয়নকে সত্যিকার অর্থে মানবমুখী করতে চায়, তবে তাকে ঋণ ও মিথ্যার ওপর নয়, উৎপাদন ও স্বচ্ছতার ওপর দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে এই উপলব্ধির ওপর—যে “ঋণ-নির্ভর উন্নয়ন” এক সময়ের জন্য উজ্জ্বল ছবি আঁকে, কিন্তু তার নিচে জমে থাকে দীর্ঘমেয়াদি অন্ধকার। সেই অন্ধকার থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজে পেতেই আজ দরকার প্রকৃত উন্নয়নের পুনঃসংজ্ঞা।
আপনার মতামত জানানঃ