
প্রায় ৬২ লাখ বছর আগে লোহিত সাগর সম্পূর্ণ শুকিয়ে এক বিশাল মরুভূমিতে পরিণত হয়েছিল। সৌদি আরবের কিং আব্দুল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (কেএইউএসটি) বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে এই বিস্ময়কর তথ্য। যদিও কিছু সময় পর ভারত মহাসাগর থেকে আসা এক ভয়াবহ বন্যা সেই শুকনো উপত্যকাকে আবারও সাগরে পরিণত করে। এই গবেষণাটি পৃথিবীর ইতিহাসে জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্র গঠন এবং ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের সম্পর্ক বোঝার এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৩ কোটি বছর আগে অ্যারাবিয়ান প্লেট আফ্রিকান প্লেট থেকে আলাদা হতে শুরু করলে লোহিত সাগরের জন্ম হয়। তখন এটি ছিল একটি সরু রিফট ভ্যালি—অর্থাৎ দুটি প্লেটের ফাঁকে তৈরি হওয়া গভীর উপত্যকা, যেখানে ছোট ছোট হ্রদ ও পানির ধারা ছিল। সময়ের সঙ্গে ভূমধ্যসাগর থেকে পানি প্রবাহিত হয়ে প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ বছর আগে লোহিত সাগর একটি বড় উপসাগরে পরিণত হয়। এতে সামুদ্রিক প্রাণবৈচিত্র্যের দ্রুত বিস্তার ঘটে। উত্তর উপকূলের দুবা ও উমলুজজ অঞ্চলে প্রাচীন প্রবালপ্রাচীরের জীবাশ্ম এখনো সেই সময়ের প্রমাণ বহন করে।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাষ্পীভবন বাড়তে থাকে, পানি সরবরাহ কমে আসে এবং সমুদ্রের লবণাক্ততা বেড়ে যায়। ফলস্বরূপ প্রায় দেড় কোটি বছর আগে সামুদ্রিক প্রাণীরা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে শুরু করে। এরপর এক সময় লোহিত সাগর সম্পূর্ণ শুকিয়ে লবণাক্ত মরুভূমিতে পরিণত হয়। কেএইউএসটির বিজ্ঞানীরা সিসমিক ইমেজিং, অণুজীবের জীবাশ্ম বিশ্লেষণ এবং জিওকেমিক্যাল ডেটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পেয়েছেন। তারা দেখিয়েছেন, ৬২ লাখ বছর আগে লোহিত সাগর তখনও ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে একটি অগভীর প্রণালী দিয়ে যুক্ত ছিল। পরে সেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে সমুদ্রটি পানিশূন্য হয়ে পড়ে।
দক্ষিণ দিকে, হানিশ দ্বীপপুঞ্জের কাছে একটি আগ্নেয়গিরির প্রাচীর তখন লোহিত সাগরকে ভারত মহাসাগর থেকে আলাদা করে রেখেছিল। এই প্রাচীরের কারণে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে সাগরটি শুকিয়ে যায়। কিন্তু কিছু সময় পর ভারত মহাসাগরের প্রচণ্ড জলচাপ সেই আগ্নেয়গিরির প্রাচীর ভেঙে দেয়। তখন বাব-এল-মানদেব প্রণালী দিয়ে ভয়াবহ বন্যা প্রবাহিত হয় লোহিত সাগর অঞ্চলে। এই বন্যার প্রবাহ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে এটি সমুদ্রতলে প্রায় ৩২০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি গভীর খাদ বা সাবমেরিন ক্যানিয়ন তৈরি করে, যা আজও সমুদ্রতলের মানচিত্রে দেখা যায়। এই বন্যা অল্প সময়ের মধ্যেই লোহিত সাগরের শুকনো লবণাক্ত ভূমিকে জলমগ্ন করে ফেলে।
গবেষণার প্রধান লেখক ড. তিহানা পেনসা বলেন, “আমাদের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, লোহিত সাগরে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম বড় পরিবেশগত ঘটনা ঘটেছিল প্রায় ৬২ লাখ বছর আগে। সে সময় এটি পুরোপুরি শুকিয়ে গিয়েছিল, আবার ভারত মহাসাগরের বন্যায় তা পূর্ণও হয়ে যায়। এই বন্যা লোহিত সাগরের অববাহিকাকে পরিবর্তন করে দেয় এবং ভারত মহাসাগরের সঙ্গে এর স্থায়ী সংযোগ তৈরি করে।” তাঁর মতে, মাত্র এক লাখ বছরের মতো অল্প সময়ের মধ্যেই এই বিশাল ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে খুবই দ্রুত একটি রূপান্তর।
এই ঘটনাটির সঙ্গে বিজ্ঞানীরা তুলনা করেছেন ভূমধ্যসাগরের বিখ্যাত জ্যানক্লিয়ান ফ্লাডের, যা ঘটেছিল প্রায় একই সময়কালে। তখন জিব্রাল্টার প্রণালী দিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের পানি প্রবাহিত হয়ে ভূমধ্যসাগরকে পুনরায় পূর্ণ করেছিল। উভয় ক্ষেত্রেই একটি প্রাচীর বা ভূতাত্ত্বিক বাধা ভেঙে গিয়ে নতুন সমুদ্রের জন্ম হয়েছিল, এবং দুই মহাসাগরের মধ্যে স্থায়ী সংযোগ তৈরি হয়েছিল। ফলে পৃথিবীর জলবায়ু, সমুদ্রপৃষ্ঠ এবং সামুদ্রিক প্রাণবৈচিত্র্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
লোহিত সাগরের ইতিহাস তাই পৃথিবীর পরিবেশগত সহনশীলতার এক অনন্য প্রমাণ। এক সময়ের সম্পূর্ণ শুকনো উপত্যকা আজ বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ সামুদ্রিক অঞ্চল। এখানে রয়েছে প্রবালপ্রাচীর, অসংখ্য মাছ ও উদ্ভিদ প্রজাতি, যেগুলোর অনেকই পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। এর লবণাক্ততা, তাপমাত্রা ও পরিবেশ বৈশিষ্ট্য একে করে তুলেছে প্রকৃতির এক প্রাকৃতিক গবেষণাগার।
গবেষকরা মনে করেন, এই ইতিহাস আমাদের শেখায় যে, পৃথিবী ধ্বংসের পরও পুনর্জন্মের ক্ষমতা রাখে। কোটি কোটি বছরের টেকটনিক পরিবর্তন, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুত্পাত এবং জলবায়ু বিপর্যয়ের মধ্য দিয়েও পৃথিবী বারবার নতুন জীবন সৃষ্টি করেছে। লোহিত সাগরের কাহিনি সেই পুনর্জন্মেরই এক অনন্য উদাহরণ। শুকিয়ে যাওয়া এক মরুভূমি আবারও হয়ে উঠেছে প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর এক সমুদ্র।
আজকের লোহিত সাগর কেবল একটি জলাশয় নয়; এটি পৃথিবীর জীবনের টিকে থাকার গল্পের এক নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। এখানে প্রকৃতি দেখিয়েছে তার অসীম শক্তি, ধৈর্য ও ভারসাম্য রক্ষার ক্ষমতা। ৬২ লাখ বছর আগে যে সাগর মৃত্যুর নিস্তব্ধতায় হারিয়ে গিয়েছিল, আজ তা আবার জীবনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে—প্রমাণ করে দিয়েছে, প্রকৃতি ধ্বংসের মধ্যেও নতুন করে জন্ম নিতে জানে।
 
	 
	 
	 
	 
	 
	 
আপনার মতামত জানানঃ