
বাংলাদেশে তরুণ-তরুণীদের আত্মরক্ষা ও অস্ত্র ব্যবহারে মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক। অন্তর্বর্তী সরকারের এই উদ্যোগকে কেউ দেখছেন জাতীয় নিরাপত্তা জোরদারের কৌশল হিসেবে, আবার কেউ বলছেন এটি ঝুঁকিপূর্ণ এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সরকারি হিসেবে প্রায় নয় হাজার তরুণ ও তরুণী এই কর্মসূচির আওতায় ১৫ দিনের আবাসিক প্রশিক্ষণ নেবেন, যেখানে শেখানো হবে জুডো, কারাতে, তায়কোন্দ এবং আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের মৌলিক কৌশল। এ ধরনের কর্মসূচি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম, যা জাতীয় প্রতিরক্ষা ও গণপ্রতিরক্ষার ধারণাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে।
যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া জানিয়েছেন, এই প্রকল্পটি মূলত পাইলট প্রোগ্রাম হিসেবে চালু করা হচ্ছে। এর উদ্দেশ্য হলো, দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীকে আত্মরক্ষার পাশাপাশি জরুরি পরিস্থিতিতে দেশের রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে প্রস্তুত করা। তিনি বলেন, “সবসময় যুদ্ধ করার প্রয়োজন নেই, কিন্তু একটা প্রস্তুতিমূলক মনোভাব থাকা দরকার। যখনই প্রয়োজন হবে, এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নাগরিকরা দেশের জন্য লড়তে পারবে।” বিকেএসপি’র সাতটি আঞ্চলিক কেন্দ্রে অনুষ্ঠিতব্য এই প্রশিক্ষণে অংশ নিতে পারবে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী বাংলাদেশি নাগরিকরা। প্রশিক্ষণ শেষে অংশগ্রহণকারীরা পাবেন ৪২০০ টাকা ভাতা, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ও পোশাক।
সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে এই কর্মসূচিকে বলা হয়েছে “আত্মরক্ষামূলক মৌলিক প্রশিক্ষণ”। প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে অস্ত্র চালানোর মৌলিক তত্ত্ব শেখানো হবে, যদিও সরাসরি গুলি ছোড়ার অনুশীলনের অনুমতি এখনও মেলেনি। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ জানান, “আমরা ‘এম’ করা, ‘পজিশনিং’, ‘ফলো থ্রু’ থেকে শুরু করে ট্রিগার টেকনিক পর্যন্ত শেখাবো, কিন্তু বাস্তব গুলি ছোড়া আপাতত সম্ভব নয়।” তিনি বিশ্বাস করেন, ভবিষ্যতে উপযুক্ত অবকাঠামো ও বাজেট পেলে লাইভ ফায়ারিং প্রশিক্ষণও অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। তার মতে, এই ধরনের প্রশিক্ষণ বাংলাদেশে গণপ্রতিরক্ষা এবং জাতীয় নিরাপত্তার একটি শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তুলবে।
তবে এই কর্মসূচি নিয়ে সমালোচনাও কম নয়। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, “এ ধরনের প্রশিক্ষণ কোনো জাতীয় কৌশল বা নীতির আওতায় নয়। অন্য দেশে এ ধরনের কর্মসূচির আগে সংসদে আইন পাস হয়, নীতিমালা থাকে, কিন্তু বাংলাদেশে তা নেই।” তিনি সতর্ক করে বলেন, অস্ত্র সংক্রান্ত কার্যক্রম অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং এতে অংশগ্রহণকারীদের ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই অত্যাবশ্যক। “যদি ভুল মানুষ প্রশিক্ষণ পায় এবং সেটা অপব্যবহার করে, তাহলে তা দেশের জন্য ভয়াবহ হতে পারে।”
দেশে সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও এই প্রকল্পকে ঘিরে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বহু অস্ত্র-গুলি লুট হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোর অনেকগুলো এখনও উদ্ধার হয়নি। এমন বাস্তবতায় যখন অবৈধ অস্ত্রের উপস্থিতি স্পষ্ট, তখন সাধারণ নাগরিকদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, অস্ত্রের মৌলিক জ্ঞান থাকলেই তা ভুল ব্যবহারের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে, বিশেষত যদি প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের উপর পর্যাপ্ত নজরদারি না থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এই কর্মসূচি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ কেউ আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণকে সময়োপযোগী বলে মনে করছেন, বিশেষত নারী নিরাপত্তার দিক থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সায়মা তাসনীম বলেন, “আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ মেয়েদের জন্য খুব দরকার। কিন্তু এই উদ্যোগ নিয়ে তেমন প্রচার হয়নি, আমরাই জানতাম না।” অন্যদিকে শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান মনে করেন, “অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে অবৈধ অস্ত্রের কারবার বাড়তে পারে।” তার মতে, অস্ত্র চালানোর মৌলিক জ্ঞান থাকলে অনেকে সেটি অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারে, যা সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে।
আরেকজন শিক্ষার্থী প্রান্ত বলেন, “দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ অনেক তরুণ আছেন, কিন্তু অস্ত্র ব্যবহার করার মানসিক পরিপক্বতা আমাদের অনেকেরই নেই। আমরা এখনো সেই স্তরে পৌঁছাইনি।” আর রাহাত আহমেদ নামের এক ছাত্রের মতে, “এই প্রশিক্ষণটা যদি আর্মির শৃঙ্খলার মতো করে দেওয়া হয়, তাহলে ভালো; কিন্তু অল্প বয়সীদের হাতে অস্ত্রের জ্ঞান দেওয়া মানে তাদের ভুল পথে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ানো।” এই মন্তব্যগুলো তরুণ সমাজের উদ্বেগের প্রতিফলন, যারা একদিকে আত্মরক্ষার প্রয়োজনীয়তা বোঝেন, অন্যদিকে অস্ত্রের সামাজিক প্রভাবও উপলব্ধি করেন।
সরকার জানিয়েছে, প্রশিক্ষণার্থীদের বাছাইয়ে কঠোর যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে। আবেদনকারীদের এসএসসি বা সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে এবং চারিত্রিক সনদপত্রসহ মামলাহীন থাকার অঙ্গীকারনামা জমা দিতে হবে। ক্রীড়া উপদেষ্টা বলেন, “আমরা স্ক্রুটিনি খুব সতর্কতার সঙ্গে করব। গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে যাতে কোনো উগ্র বা জঙ্গী গোষ্ঠীর সদস্য ঢুকতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করবো।” বাছাই প্রক্রিয়ায় থাকবে আর্মি ব্যাকগ্রাউন্ডের কর্মকর্তারা, বিকেএসপি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি।
এই কর্মসূচি ধাপে ধাপে দুই থেকে আড়াই বছরে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রাথমিকভাবে সাতটি আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ১৫ দিনের ব্যাচভিত্তিক কোর্স চালু হবে। চারটি শাখায়—জুডো, কারাতে, তায়কোন্দ ও শ্যুটিং—প্রতিটি শাখায় তিন থেকে চার দিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ২৮ কোটি টাকা। উপদেষ্টার দাবি, “এই প্রশিক্ষণ কোনো বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে নয়। এটি রিজার্ভ ফোর্সের বিকাশ ও আত্মরক্ষার সক্ষমতা বৃদ্ধির অংশ।”
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ এই কর্মসূচিকে “রাজনৈতিক রেটরিক” বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, “আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই এমন উত্তেজনাপূর্ণ বিষয় নিয়ে জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায়। এই কর্মসূচিও তার অংশ হতে পারে।” তার মতে, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে “গণপ্রতিরক্ষা” ও “অস্ত্র প্রশিক্ষণ” বিষয়গুলো জনপ্রিয়তা সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সব মিলিয়ে, আত্মরক্ষা ও অস্ত্র প্রশিক্ষণের এই কর্মসূচি বাংলাদেশের নিরাপত্তা নীতি, প্রশাসনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য—সবকিছুরই এক সংবেদনশীল মিশ্রণ তৈরি করেছে। একদিকে সরকার বলছে, এটি তরুণদের আত্মনির্ভর ও সাহসী করে তুলবে; অন্যদিকে সমালোচকরা আশঙ্কা করছেন, এটি সমাজে অস্ত্র সংস্কৃতির সূচনা করতে পারে। বাংলাদেশ যে এখন রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে, এই কর্মসূচি সেটিকে আরও স্পষ্ট করেছে। এটি সত্যিই দেশের প্রতিরক্ষা জোরদারের পদক্ষেপ, নাকি এক রাজনৈতিক কৌশল—সেটি সময়ই বলে দেবে।
	
	
	
	
	
আপনার মতামত জানানঃ