গাজায় দীর্ঘ সংঘাতের পর যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, “গাজায় যুদ্ধ শেষ হয়েছে”। এয়ারফোর্স ওয়ানে ইসরায়েলের উদ্দেশে যাত্রা করার আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, যুদ্ধবিরতি এখন কার্যকর আছে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি নিজেকে সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি মনে করেন। ট্রাম্পের এই বক্তব্য নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। কারণ গাজা অঞ্চলের সংঘাত, জিম্মি সংকট এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েন এতটাই গভীর ছিল যে, “যুদ্ধ শেষ” ঘোষণা কোনো বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় কিনা তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে নানা প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
ট্রাম্প বলেন, “যুদ্ধ সমাধানে আমি ভালো। শান্তির জন্য আমি ভালো।” তিনি উল্লেখ করেন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে তার সম্পর্ক এখন অত্যন্ত ভালো। অতীতে কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও তা দ্রুত মিটে গেছে। নেতানিয়াহুর প্রশংসা করে ট্রাম্প বলেন, “তিনি চমৎকার কাজ করেছেন।” একইসাথে কাতারের ভূমিকাও তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। ট্রাম্প বলেন, “কাতারের কৃতিত্ব পাওয়া উচিত। তারা যেভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছে, তা অসাধারণ।”
ট্রাম্প এর আগেও বেশ কয়েকবার নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। এবারও তিনি বলেন, “গাজায় সংঘাত হলো অষ্টম যুদ্ধ যা আমি সমাধান করেছি। আমি এটা নোবেলের জন্য করিনি, করেছি মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য।” তার এই বক্তব্যে অনেকে মনে করছেন, ট্রাম্প আবারও আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নিজের ভূমিকা জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন।
একই সময় তেলআবিবে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হতে শুরু করেছে। তারা অপেক্ষা করছে গাজায় বন্দি থাকা তাদের প্রিয়জনদের ফিরে পাওয়ার। সেখানে বড় পর্দায় সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে সবাই জিম্মিদের মুক্তির দৃশ্য দেখতে পারে। কয়েক মাস ধরে এই স্থানেই নিয়মিত সমাবেশ ও বিক্ষোভ হয়েছে জিম্মিদের মুক্তির দাবিতে। ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স জানিয়েছে, এবারও আগের মতোই রেড ক্রসের মাধ্যমে জিম্মিদের হস্তান্তর করা হবে। পরে তাদের ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলীয় সামরিক ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হবে, যেখানে পরিবারের সদস্যরা অপেক্ষা করবেন প্রিয়জনদের বরণ করে নিতে।
এদিকে জানা গেছে, আজ হামাস ৪৮ জন জিম্মিকে মুক্তি দিতে পারে। এদের মধ্যে প্রায় ২০ জন জীবিত আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন অ্যারিয়েল কুনিও ও তার ভাই ডেভিড কুনিও, যাদের ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর অপহরণ করা হয়েছিল। পরিবারের কাছে পাঠানো তাদের সর্বশেষ বার্তায় লেখা ছিল, “আমরা যেন এক হরর মুভির মধ্যে আছি।” এছাড়া এভিয়াটার ডেভিড, যাকে নোভা উৎসব থেকে অপহরণ করা হয়েছিল, এবং ২৮ বছর বয়সী জমজ ভাই গালি ও জিভ বারম্যানও তাদের মধ্যে রয়েছেন। তাদের কিবুতয কেফার আজা থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল হামাস।
তাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক বন্দি হলেন ওমরি মিরান, যার বয়স ৪৮ বছর। বাকিদের মধ্যে রয়েছেন মাতান আংরেস্ট, মাতান জানগৌকার, নিমরদ কোহেন, গাই গিলবোয়া ডালাল, ইয়োসেফ চাইম ওহানা, এলকানা বহবত, আভিনাতান ওর, এইতান ওর, বার কুপারশটেইন, সেগেভ কালফন এবং রম ব্রাসলাভস্কি। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এইসব পরিবার আজ স্বজনদের ফিরে পাওয়ার আশায় প্রহর গুনছে।
এই প্রেক্ষাপটে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি গাজা শান্তি বৈঠকের আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন। মিশরে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই বৈঠকে যোগ দেবেন বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নেতা, যেমন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাঁক্র, জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেৎস, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি ও স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেড্রো সানচেজ। এই বৈঠক থেকে গাজায় স্থায়ী শান্তির পথ খুঁজে বের করার প্রত্যাশা করছে আন্তর্জাতিক মহল।
ট্রাম্প এ সময় আরও জানান, তিনি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা সম্পর্কেও শুনেছেন। যদিও এই বিষয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি, তবে ইঙ্গিত দিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতাও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের বিষয়। তার মতে, শান্তি রক্ষা এবং জিম্মি সংকট সমাধানে বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণ দরকার, এককভাবে কেউ এ সমস্যার সমাধান করতে পারবে না।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে ট্রাম্প বলেন, তিনি এখনো সিদ্ধান্ত নেননি সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার তার প্রস্তাবিত “বোর্ড অব পিস”-এ থাকবেন কি না। ট্রাম্প বলেন, “আমি সবসময় টনিকে পছন্দ করি, কিন্তু দেখতে হবে তিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য পছন্দ কিনা।” তিনি আরও জানান, দ্রুত এই বোর্ড গঠন করতে চান যাতে বৈঠকে আলোচনা হওয়া শান্তি পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করা যায়।
এর আগে পিএলও’র এক উপপ্রধান সামাজিক মাধ্যমে টনি ব্লেয়ারের সঙ্গে একটি বৈঠকের ছবি শেয়ার করে জানান যে, গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা আলোচনায় বসেছেন এবং ট্রাম্প ও ব্লেয়ারসহ অন্যদের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত আছেন। এতে ধারণা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে গাজা পুনর্গঠন ও শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে টনি ব্লেয়ারেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে।
তেলআবিবের মানুষদের মধ্যে এখনো উত্তেজনা ও আশা দুটোই রয়েছে। যারা পরিবার হারিয়েছে বা এখনো কোনো খোঁজ পায়নি, তাদের জন্য এই যুদ্ধবিরতি আশার আলো হয়ে এসেছে। কিন্তু যুদ্ধ শেষের ঘোষণা সত্যিই কতটা স্থায়ী হবে, তা সময়ই বলে দেবে। অতীতে গাজায় একাধিক যুদ্ধবিরতি স্বল্প সময়েই ভেঙে গেছে, তাই মানুষ এখনো পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছে না।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের এই বক্তব্য রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও দেখা যেতে পারে। তিনি আবারও বিশ্বমঞ্চে নিজেকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সক্ষম নেতা হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন। মার্কিন নির্বাচনের প্রাক্কালে মধ্যপ্রাচ্যে তার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা বাড়বে বলেও তারা মনে করছেন। তবে বাস্তবতা হলো, গাজা অঞ্চলের পুনর্গঠন, জিম্মিদের নিরাপদ মুক্তি ও স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান এখনো বহু দূরের পথ।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও সেখানে মানবিক সংকট রয়ে গেছে। ঘরবাড়ি ধ্বংস, বিদ্যুৎ ও পানির সংকট, চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এখনও ভয়াবহ। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, মানবিক সহায়তা অব্যাহত না থাকলে পরিস্থিতি আবারও খারাপ হতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য হয়তো কিছুটা স্বস্তি এনেছে, তবে শান্তির বাস্তব ভিত্তি তৈরি করতে ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। যদি সত্যিই যুদ্ধ শেষ হয়, তবে সেটি হবে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে এক বড় মোড় পরিবর্তন। কিন্তু এখনো অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে—এই শান্তি কতটা স্থায়ী হবে, ভবিষ্যতে আর সংঘাত হবে না তো, এবং দুই পক্ষই কি প্রকৃতপক্ষে একে অপরের প্রতি আস্থা রাখতে পারবে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজছে পুরো বিশ্ব। গাজার মানুষের চোখে এখনো ভয়, কিন্তু সেই ভয় ছাপিয়ে একটুখানি আশার আলোও জ্বলছে। ট্রাম্পের “যুদ্ধ শেষ” ঘোষণা সেই আশাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন সময়ই বলবে, এই ঘোষণা ইতিহাসে সত্যিকারের শান্তির সূচনা হিসেবে জায়গা পায় কিনা।
আপনার মতামত জানানঃ