বাংলাদেশে যখন সরকার পরিবর্তনের হাওয়ায় ‘সংস্কার’ নামক রঙিন ফানুস উড়ছে, তখন সেই ফানুসের নিচেই চাপা পড়ে যাচ্ছে একের পর এক সংখ্যালঘুদের আর্তনাদ। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে যে আশার আলো দেখা গিয়েছিল, তা এখন ধীরে ধীরে কালো ধোঁয়ায় পরিণত হচ্ছে—আর সেই ধোঁয়ার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি যাদের শ্বাসনালীতে জমেছে, তারা এই দেশেরই নাগরিক—ধর্মীয় সংখ্যালঘু, যাদের নাকি নীতিগতভাবে “সবচেয়ে সমান অধিকার” থাকার কথা।
হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নেতারা স্পষ্ট ভাষায় বলছেন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত কোনো কমিশনেই তাদের অংশগ্রহণ নেই। সংবিধান সংশোধন, প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস, বা এমনকি ন্যূনতম মতামতের জায়গাগুলোতেও তাদের ডাকা হয়নি। অর্থাৎ ‘সংলাপের বাংলাদেশে’ সংখ্যালঘুদের জন্য কোনো চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়নি, অথচ প্রতিশ্রুতি ছিল সবার জন্য নতুন এক টেবিল তৈরির।
মজার বিষয় হলো, বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা কিংবা পুলিশ সদর দপ্তরের বিবৃতি শুনলে মনে হবে—সংখ্যালঘুরা যেন কোনো অলীক ভয়ের জগতে বাস করছে। তারা বলছে, “কোনো হত্যাকাণ্ডই সাম্প্রদায়িক নয়”—সবই নাকি জায়গা-জমি, টাকা-পয়সা, তরমুজ বা পারিবারিক দ্বন্দ্ব নিয়ে। অথচ বাস্তবতা হলো, গত ১১ মাসে ২ হাজার ৪৪২টি সহিংসতা, যার মধ্যে সবচেয়ে নৃশংস সময়কাল ছিল গত বছরের ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত। এক সপ্তাহের মধ্যে ২০১০টি হামলা, যার মধ্যে ১৭৬৯টি ছিল সরাসরি সাম্প্রদায়িক!
পুলিশ স্বীকার করেছে, এর মধ্যে ১৪৫৭টি ঘটনার সত্যতা পেয়েছে। মামলা হয়েছে মাত্র ৬২টি, আর গ্রেপ্তার মাত্র ৩৫ জন! মানে, প্রতিদিন যদি কেউ মন্দিরে আগুন দেয়, নারী ধর্ষণ করে, সংখ্যালঘুর বাড়ি দখল করে নেয়, তারপরও সে জানে—ধরা পড়বে না, শাস্তি হবে না। কারণ, সরকার কিংবা পুলিশের মতে, এসব ‘রাজনৈতিক’ কিংবা ‘পারিবারিক’।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি সংগঠনগুলো যখন বলে, “আমরা তো এখন অভিযোগ জানাতেও ভয় পাচ্ছি, আগে অন্তত পুলিশ আসতো”—তখন এটা কেবল একটি ভয় বা হতাশা নয়, বরং একটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার নির্মম দলিল। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হলে এ দেশে ন্যূনতম নিরাপত্তার দাবিও এখন রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো।
চট্টগ্রামে চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রহ্মচারীর ঘটনাই ধরুন। তাকে আট মাস ধরে কারাবন্দি রাখা হয়েছে মিথ্যা মামলায়। জামিন মিললেও পরে আরও কয়েকটি মামলা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে—এ যেন রীতিমতো রাষ্ট্রীয় হুমকি: মুখ খুললে এমন পরিণতি হবে। এই যদি হয় একজন নেতার অবস্থা, তাহলে একজন সাধারণ সংখ্যালঘুর জীবনে প্রতিদিনই ভয়, আতঙ্ক, অপমান আর মৌলিক অধিকার হারানোর বাস্তবতা।
আর যখন আপনি শুনবেন, ঢাকার খিলক্ষেতে দুর্গা মন্দির ভাঙা হয়েছে, তখন প্রথমেই ভাববেন—হয়তো কোনো উগ্রবাদী হামলা। কিন্তু না! এটা হয়েছে সরকারের উচ্ছেদ অভিযানে—যেখানে প্রতিমাগুলোও ভেঙে ফেলা হয়েছে। অথচ এই মন্দিরের অস্থায়ী অনুমোদন ছিল রেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে! তাহলে প্রশ্ন আসে—কোন নিয়মে মন্দির ভাঙা হলো, কোন নীতিতে প্রতিমা গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো? এবং এই কাজটির পেছনে কে উস্কানি দিল, যখন আগের রাতেই স্থানীয় জনতা মিছিল করে আল্টিমেটাম দিয়েছে?
আরেক ধাক্কা আসে লালমনিরহাট, যশোর, নড়াইলের খবরগুলো থেকে। ধর্ষণ, হত্যা, নারীকে বিষ খাওয়ানো, ভয় দেখানো—এগুলোর সবগুলো ঘটনায় একটা অদৃশ্য হাত কাজ করেছে, যার নাম “মব”, যার উৎস “রাজনীতি”, যার আশ্রয় “রাষ্ট্রীয় নীরবতা”।
বাসনা মল্লিকের ঘটনাই ধরুন—একজন নির্বাচিত নারী ইউপি সদস্যকে ধর্ষণ করে মুখে বিষ ঢেলে হত্যা করা হয়, কারণ তিনি চাঁদা দিতে অস্বীকার করেছিলেন। তার ছেলে রিংকু মামলার কথা বললে সরকারী ওসি বলেন, “আসামিদের গ্রেপ্তার করেছি, তদন্ত চলছে।” অথচ হাসপাতালের রিপোর্টে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—ধর্ষণের আলামত আছে। তাহলে এই তদন্ত কোথায় যাচ্ছে? আর যে আসামির নাম বাদ পড়েছে—সে কি অলৌকিকভাবে বেঁচে যাবে, নাকি তার মৃত্যুই একমাত্র বিচার?
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. খালিদ হোসেন যখন বলেন, “সব নাগরিক সমান, সংখ্যালঘু বলে কিছু নেই”—তখন এই কথা শুধু অসত্যই নয়, বরং অপমানজনক। কারণ, বাস্তবে যাদের মন্দির ভাঙা হয়, বাড়ি পোড়ানো হয়, নারী লাঞ্ছিত হয়, কিংবা যারা কোনো কমিশনেই জায়গা পায় না—তাদের অবস্থান প্রমাণ করে যে তারা সমান নয়, রাষ্ট্রচ্যুত একরকম ‘সহনীয় অসুবিধা’।
রাষ্ট্র যখন নিজের নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে, তখন সেটিকে আর গণতন্ত্র বলা যায় না। অন্তর্বর্তী সরকারের এই সংস্কার-নাটকে সংখ্যালঘুদের জন্য কোনো দৃশ্যপট নেই। তারা কেবল দর্শকও নয়—বরং পর্দার বাইরে রাখা অবাঞ্ছিত এক অস্তিত্ব।
রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা বলবেন, “সবকিছু শান্তিপূর্ণ, তদন্ত চলছে”—কিন্তু মন্দির যখন ভাঙে, নারী যখন বিষ খেয়ে মরে, কিংবা ধর্মীয় পরিচয়ে কাউকে জেলে পোরা হয়, তখন সে শান্তি কার জন্য? রাষ্ট্র কি তাহলে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের আনন্দ নিশ্চিত করার যন্ত্র?
এখন প্রশ্ন হলো—এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা কি নতুন কিছু? না, বরং ২০০১ সাল থেকেই এটি নির্বাচনের পর এক সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। ভোট গেলেই সংখ্যালঘুদের রক্ত ঝরে, বাড়ি পোড়ে, মন্দির ভাঙে। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে—রাষ্ট্রীয় স্তব্ধতা।
এই দেশ যদি সত্যিই “সবার বাংলাদেশ” হতো, তাহলে সংখ্যালঘুদের মঞ্চে ডাক না থাকত না। তাদের ভয় থাকত না অভিযোগ তুলতে, তাদের বাড়ি পাহারা দিতে হতো না, চিন্ময়ের মতো মানুষদের আট মাস জেলে থেকে জামিনের জন্য লড়তে হতো না। একথা বারবার বলার সময় এসেছে—এই রাষ্ট্র শুধু শাসন করছে না, নির্বাচন করছে না, বরং ‘নিষ্ক্রিয়ভাবে একপাক্ষিক জাতি নির্মাণ’ করছে।
এটা এক চরম আত্মবিরোধিতা—যেখানে সংবিধানে লেখা “ধর্মনিরপেক্ষতা”, অথচ বাস্তবে চলছে পরিকল্পিত, কাঠামোগত বৈষম্য। এমন অবস্থা চলতে থাকলে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি শুধু গণতন্ত্র নয়—মানবতারও পরীক্ষা ফেল করবে।
আপনার মতামত জানানঃ