মূলত অন্য ধর্মের মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত লাগে এমন কিছু বলা বা করাই হল ধর্ম অবমাননা। অন্তত বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননা বলতে যে শুধু ইসলাম ধর্ম অবমাননাই বোঝায় তা বুঝতে বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া লাগেনা। তখন মনে প্রশ্ন জাগে, তবে মুসলিমদের হাতে মন্দির, গির্জা ও বুদ্ধ মন্দিরে হামলা আর মূর্তি ও পবিত্র গ্রন্থে অগ্নিসংযোগ ও পদদলিত করা কি হিন্দু, বুদ্ধ ও খ্রিস্টানদের ধর্ম অবমাননা নয়!
সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারকে আমরা রাজনৈতিক বলে অভিহিত করে থাকি। যদিও তা আদতে ধর্মীয় ট্যাগ মুক্ত হতে পারে না। এটা মূলত একই সাথে রিলিজিয়াস এন্ড পলিটিক্যাল ক্যালামিটি। ২০০১–এর নির্বাচনের পর সারা দেশে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন ও নৃশংসতা চালিয়েছিল, সেটিকে অনেকটা পুঁজি করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন। সত্য উদ্ঘাটনের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার একটি কমিশনও গঠন করেছিল, যার রিপোর্ট কয়েক বছর আগেই জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে মামলা কিংবা শাস্তি হওয়ার খবর পাওয়া যায় না। শাস্তি পায়নি রামু বা সাঁথিয়ায় ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার দোহাই দিয়ে যারা সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে আক্রমণ চালিয়েছিল, তারাও।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, আক্রমণকারীরা বহিরাগত। স্থানীয় কেউ হামলা করেনি। এ তথ্য যদি সঠিকও ধরে নিই, স্থানীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের লোকেরা কী করেছেন? তাঁরা কেন নিরাপত্তা দিতে পারলেন না? কেউ কেউ দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও তা কাজে আসেনি। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান সরকারের ইন্ধনে ঢাকায় দাঙ্গা লাগানো হয়েছিল এবং সেই দাঙ্গা রুখতে আমির হোসেন চৌধুরী নামের একজন মুসলমান দাঙ্গাকারীদের রুখতে গিয়ে তাদের হাতে জীবন দিয়েছিলেন। কিন্তু, আরও বেশিসংখ্যক মানুষ কেন প্রতিরোধে এগিয়ে আসবেন না?
২০০১-এর নির্বাচনের পর ঢাকার অদূরে শ্রীপুরে আক্রান্তকবলিত এক গ্রামে গেলে সংখ্যালঘু পরিবারের নারীরা বলেছিলেন, ‘বাবা, ভোটার তালিকা থেকে আমাদের নামটি বাদ দাও। তাহলে ভোটের কারণে কেউ আমাদের ঘরবাড়িতে হামলা চালাবে না।’
বাংলাদেশকে শান্তি ও সম্প্রীতির দেশ বলে আমরা বড়াই করি। কিন্তু সেই শান্তি ও সম্প্রীতি যারা ভঙ্গ করে, যারা ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করে, যারা ভিন্ন ধর্মের মানুষের ঘরবাড়ি লুট করে, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো প্রতিবাদ দেখি না। আমাদের প্রশাসন খুবই দায়িত্বশীল। রাজনীতিকেরা পরমতসহিষ্ণুতার জ্বলন্ত প্রতীক। আমাদের নাগরিক সমাজ মানবাধিকারের বলিষ্ঠ খেদমতগার। এসবের পরও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-হামলার ঘটনা ঘটে চলেছে। এবং এই নির্যাতন কখনো ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করতে পারেনি। ধর্মীয় অনুভূতি আছে শুধু ইসলাম ধর্মের এবং এই ধর্মের অনুসারী মানুষের। তাদের বাড়িঘরে হামলা বা আক্রমণের প্রয়োজন পড়ে না, শুধুমাত্র ফেসবুকে একটি পোস্ট করেই ইসলাম ধর্মের অবমাননা করা সম্ভব।
অতি সাম্প্রতি ফেসবুকে করা একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে টাঙ্গাইল জেলার সখিপুরে একটি হিন্দু বাড়িতে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা নিয়ে একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, শনিবার রাতের ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রবিবার পাল্টাপাল্টি মামলা করেছেন যার বাড়িতে হামলা হয়েছে সেই ব্যক্তি এবং স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন।
টাঙ্গাইলের সখিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাকির হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এক হিন্দু ব্যক্তির ফেসবুক আইডি থেকে একটি কমেন্টের পর ওই ব্যক্তি শনিবার রাতে থানায় জিডি করে বলেছেন যে, তার ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে। এই ঘটনায় দুই পক্ষই মামলা করছে। আমরা ঘটনাটি খতিয়ে দেখছি” যোগ করেন তিনি।
হামলার ঘটনার সময়কার কিছু ভিডিও রবিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা যায় বাড়িটির আসবাবপত্র, টিনের বেড়া, দরজা জানালা ভাঙচুর করছে একদল ব্যক্তি। যাদের বেশিরভাগই ছিল বয়সে যুবক ও তরুণ।
শনিবার বিকেলে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে উত্তরের জেলা নীলফামারী থেকে একটি খবর লাইভ সম্প্রচার করা হয়, যাতে ওই জেলার একটি ইউনিয়নে শতবর্ষী এক বটগাছের ভেতর থেকে ‘ত্রিশুলযুক্ত একটি হাত’ বের হবার দাবি করা হয়।
বেসরকারি টেলিভিশনের ফেসবুক পাতায় ওই খবরের নিচে করা একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে টাঙ্গাইলের এই ঘটনার সূত্রপাত। সেখানে শংকর সাহা নামের এক ব্যক্তির ফেসবুক একাউন্ট থেকে মুসলামনদের সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্যের অভিযোগ ওঠে।
ওই কমেন্টের নিচেও কেউ কেউ মন্তব্য করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ করেন। স্থানীয় সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম সানি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ওই কমেন্টের স্ক্রিনশট এলাকায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই কিছুক্ষণের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, শনিবার রাতে তারাবি নামাজের পর বড়চনা বাজারের কেন্দ্রীয় মসজিদের মুসল্লিরা বিক্ষোভ করে। এক পর্যায়ে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে তারা স্থানীয় বাজারে আসার পর সেখানে পুলিশও উপস্থিত হয়।
ওই ঘটনার সময় ফেসবুকে কয়েকজনকে লাইভ করতেও দেখা যায়। যেখানে মি. সাহার বাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে ব্যাপক ভাঙচুর চালাতে দেখা গেছে।
সখিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমাদের পুলিশ ছিল অল্প। ওখানে লোক ছিল এক থেকে দেড়শো। আমার ফোর্স চেষ্টা করেও পারেনি তাদের থামাতে।”
তিনি বলেন, “শুধু পুলিশ না, স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেক হামলা চালাতে নিষেধ করে বলেছিল, হামলা কোন সমাধান না, শংকরকে বলবো সে ক্ষমা চেয়ে কমেন্ট ডিলিট করে দিবে।”
কিন্তু এই যে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার নাম করে হিন্দুদের বাড়িঘরে আক্রমণ করা হলো, মন্দিরে হামলা হলো, সেটি ধর্ম অবমাননা নয়? কিন্তু অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে নিয়ত আঘাত করা হচ্ছে। কই, তারা তো কখনো কারও ওপর হামলা চালায় না। এমন কোনো মাস নেই যে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা হয় না। প্রতিমা ভাঙচুর হয় না।
মুসলিমগণ প্রায়শই দাবী করেন, তাদের নবীকে সকলের সম্মান এবং শ্রদ্ধা করতে হবে। কেউ নবী মুহাম্মদের কার্টুন আঁকলে, ছবি বানালে, মুসলিম উম্মাহ উন্মাদের মত তাদের গলা কাটে। শার্লি এবদো নামক ফরাসী কার্টুন ম্যাগাজিনের ১২ জন কার্টুনিস্টকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগে কিছু মুসলিম সন্ত্রাসী হত্যা করেছিল। এই কয়েকদিন আগেই, ক্লাসরুমে বাক স্বাধীনতা বিষয়টি পড়াবার সময়ে ফ্রান্সের একজন শিক্ষক শার্লি এবদোর কিছু কার্টুন ক্লাসরুমে দেখিয়েছিল। ফলশ্রুতিতে তাকেও হত্যা করেছে এক চেচেন মুসলিম।
মুসলিমদের দাবী, তাদের ধর্মের নবীকে সম্মান করতে হবে। অথচ, অন্য ধর্মের মূর্তি ভাঙ্গার সময় বিষয়টি কী তাদের মনে থাকে? উল্লেখ্য, তারা যে সব দেশই এই পর্যন্ত দখল করেছে, প্রায় সব দেশেই প্রাচীন মূর্তি এবং মন্দিরগুলো একদমই ধ্বংস করে ফেলেছে। আফগানিস্তানে তালেবানদের ২০০০ বছর পুরনো বৌদ্ধ মূর্তিগুলো ধ্বংস করার মত ঘটনা অসংখ্যবারই ঘটেছে, আইসিসও কম যায় নি। বাঙলাদেশে তো মূর্তি আর মন্দির ভাঙ্গাভাঙ্গি প্রতি মাসের ব্যাপার। কিন্তু এই মূর্তি ভাঙ্গা কী ইসলাম সম্মত?
একজন হিন্দুর কাছে দূর্গা কিংবা শিব বা কালীর মূর্তিও কিন্তু সম্মানিত এবং পবিত্র বিষয়। বাঙলাদেশে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নানা মন্দিরে মূর্তি ভাঙ্গা হয়। ওয়াজে হুজুররা প্রায় প্রতি সপ্তাহেই মূর্তি ভাঙ্গার উষ্কানি দেন। অথচ, ইসলামের বিধান হচ্ছে, কেউ যদি নবী মুহাম্মদের সামান্যতম সমালোচনাও করে, তাকে বিনা বিচারে যেকোন মুসলিম গিয়ে জবাই করে আসতে পারে। ইসলামে শাতিমে রাসুলের শাস্তি দিতে কোন বিচার আচারের প্রয়োজন নেই। এর মানে হচ্ছে, মুসলিমরা ঠিকই অন্য ধর্মের অবমাননা করতে পারবে, কিন্তু অন্য কেউ ইসলামের বিষয়ে কিছুই বলতে পারবে না। অন্য ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ করা নাকি তাদের ধর্মীয় অধিকার!
আপনার মতামত জানানঃ