এই ঘটনাবহুল বাণিজ্য সংকটের প্রেক্ষাপটে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। একসময় যে দুই নেতা—ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদি—এক অপরকে ‘বন্ধু’ বলে আখ্যায়িত করতেন, আজ তাদের নেতৃত্বাধীন দেশদ্বয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংঘাতে রূপ নিয়েছে সম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কেবল বাণিজ্যিক প্রতিক্রিয়া নয়; এর মধ্যে ভূরাজনৈতিক বার্তাও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের এই ৫০ শতাংশ শুল্ক ভারতের অর্থনীতির ওপর একটি বড় ধাক্কা। কারণ এটি এমন এক সময় এসেছে, যখন ভারত নিজেকে বিশ্বের অন্যতম বড় উৎপাদন ঘাঁটি হিসেবে গড়ে তুলতে চায়, বিশেষত চীনের বিকল্প হিসেবে। কিন্তু এত উচ্চ শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করা কঠিন হয়ে পড়বে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও ভারতের প্রতি আগ্রহ হারাতে পারেন। অ্যাপলের মতো কোম্পানি যাদের পরিকল্পনা ছিল ভারত থেকে মার্কিন বাজারে আইফোন সরবরাহ করার, তারা এখন নতুন করে ভাবতে বাধ্য হবে।
শুল্ক বাড়ানোর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি হচ্ছে, ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি ও অস্ত্র কিনে তাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে কার্যত অগ্রাহ্য করছে। এটি কেবল বাণিজ্য নয়, বরং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বার্তারও বহিঃপ্রকাশ—‘আমাদের সঙ্গে থাকো, নতুবা মূল্য দাও।’ কিন্তু ভারত এই বার্তা সহজে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। দিল্লি বলছে, রাশিয়ার সঙ্গে তাদের জ্বালানিনির্ভরতা ১৪০ কোটির জনগণের জাতীয় প্রয়োজন। এই অবস্থান থেকে সরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ, বিশেষত যখন এই জ্বালানিনীতির মাধ্যমে তারা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপের বিপরীতে ভারত কিছু সংবেদনশীল খাতে ছাড় দিতে রাজি হয়নি। বিশেষ করে কৃষি ও দুগ্ধখাত, যেখানে লাখো দরিদ্র ভারতীয় কাজ করে। এই খাতের ওপর মার্কিন পণ্যের অনুপ্রবেশ দেশীয় রাজনীতিতে মোদিকে বিপাকে ফেলতে পারে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশার সঙ্গে ভারতের কৌশলগত অবস্থান সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফলে এই পরিস্থিতি এখন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ‘মৃত অর্থনীতি’র ইঙ্গিতবাহী। যদিও ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক বাণিজ্য পরিমাণ ২০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি, তবু এর ভেতরের আস্থার ঘাটতি চোখে পড়ছে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই টানাপোড়েন যদি দীর্ঘায়িত হয়, তবে চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক পুনঃগঠনের চেষ্টাও গতি পেতে পারে। মোদির আসন্ন চীন সফর এবং সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের সম্মেলনে অংশগ্রহণ সেই ইঙ্গিতই বহন করে।
তবে ট্রাম্প প্রশাসনের কৌশল একদিকে ‘অনশোরিং’, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রেই উৎপাদন বাড়ানো; অন্যদিকে ‘শাস্তিমূলক বাণিজ্যনীতি’, যা বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলোর ওপরও প্রয়োগ করা হচ্ছে। এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের ভিনা নাজিবুল্লাহ যেমন বলেছেন, এটি একটি অপ্রত্যাশিত সংকট। বিশেষ করে এমন একটি সময়ে, যখন কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে সরবরাহ শৃঙ্খলা পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল।
এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যবর্তী ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি বরাবরই ‘স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি’র পক্ষে, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার পক্ষে একতরফাভাবে দাঁড়ানো নয়। কিন্তু এখন ট্রাম্পের শুল্কারোপ ভারতের সেই কৌশলিক ভারসাম্যকেও চ্যালেঞ্জ করছে।
অন্যদিকে, পাকিস্তান এখন সুযোগ নিচ্ছে। তারা ট্রাম্পের সঙ্গে খনিজ ও জ্বালানিভিত্তিক চুক্তিতে এগিয়ে গেছে, এমনকি তাকে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার কথাও বলেছে। ট্রাম্পও দেখাতে চাইছেন, তার কৌশলগত বন্ধুত্ব নতুনভাবে পুনর্গঠিত হচ্ছে—যেখানে ভারত হয়তো আর প্রথম সারির মিত্র নয়।
এই অবস্থায় দিল্লি যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে চায়, তবে কূটনৈতিকভাবে আরো সৃজনশীল এবং বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও জাপানের মতো অংশীদারদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করে বিকল্প প্রস্তুত রাখতে হবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের মতো অস্থির সিদ্ধান্তগ্রহণকারী রাষ্ট্রের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল থাকা ঝুঁকিপূর্ণ।
সবশেষে, রবার্ট রগোস্কির কথার সঙ্গে একমত হওয়া যায়—মোদি নিজে একজন শক্তিশালী নেতা, এবং তাকে চাপের মুখে ফেললে প্রতিক্রিয়া আসবেই। এখন দেখা যাক, প্রতিক্রিয়াটি কি শান্তিপূর্ণ পুনর্মিলন নাকি আরও বড় সংঘাতের দিকেই গড়ায়। তবে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ট্রাম্পের এই শুল্কারোপ শুধু অর্থনীতিকে নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক মানচিত্রকেই নতুন করে আঁকার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ