ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই ভারত–মার্কিন সম্পর্ক ভয়াবহ সংকটে পড়েছে। গত এক চতুর্থাংশ শতাব্দীর মধ্যে এই সম্পর্ককে সবচেয়ে নাজুক বলা হচ্ছে। এমনকি খবর এসেছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে ট্রাম্পের ফোন ধরেননি। গত বছর নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ট্রাম্পকে দিল্লিতে অনেকেই স্বাগত জানিয়েছিলেন। মোদি নিজেও তাঁকে ‘বন্ধু’ বলে শুভেচ্ছা জানিয়ে উষ্ণ ছবি প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু খুব দ্রুত সেই সম্পর্ক ভেঙে পড়তে শুরু করে।
প্রথম ধাক্কা আসে বাণিজ্য ইস্যুতে। হোয়াইট হাউসে বৈঠকে মোদি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও অস্ত্র, তেল ও গ্যাস কেনার প্রতিশ্রুতি দেন এবং আশা করেন ভারতীয় পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক প্রত্যাহার হবে। কিন্তু ট্রাম্প সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেননি। বরং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ঘোষণা দেন, ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে—যা চীনের ওপর আরোপিত শুল্কের চেয়ে বেশি। এতে ভারতের অর্থনীতি চাপে পড়ে এবং মোদি সরকার অস্বস্তিতে পড়ে।
এই সময়েই কাশ্মীরে ঘটে যায় ভয়াবহ হামলা। এপ্রিলের ২২ তারিখ বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন হিন্দু পর্যটক। সঙ্গে সঙ্গে অঞ্চলটি আবারও ভারত–পাকিস্তান সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। নয়াদিল্লি ঘোষণা দেয়, এবারও শক্ত হাতে জবাব দেওয়া হবে। এর পর পাকিস্তান ও পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে সশস্ত্র শিবিরে ভারত হামলা চালায়। দ্রুত সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে, ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহৃত হয়, দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ যুদ্ধের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ১০ মে দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলেও পরিস্থিতি বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক তৈরি করে।
এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প নিজেকে শান্তিদূত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দেন, তাঁর মধ্যস্থতায় দুই দেশ সংঘর্ষ বন্ধ করেছে এবং শিগগিরই আলোচনায় বসে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করবে। পাকিস্তান এতে খুশি হলেও ভারত ক্ষুব্ধ হয়। কারণ, দিল্লির দীর্ঘদিনের অবস্থান হলো কাশ্মীর প্রশ্ন দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হবে, তৃতীয় পক্ষের কোনো ভূমিকা গ্রহণযোগ্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রও এত বছর সেই নীতি সমর্থন করে এসেছে, কিন্তু ট্রাম্প ভিন্নপথে হাঁটায় নয়াদিল্লি বিব্রত হয়।
এমন পরিস্থিতিতেই পাকিস্তান কৌশলী পদক্ষেপ নেয়। তারা ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেয়। এতে উৎসাহিত হয়ে ট্রাম্প মোদিকে অনুরোধ করেন, কানাডা সফরের ফেরার পথে ওয়াশিংটনে এসে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের সঙ্গে বৈঠক করতে। মোদি সরাসরি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এটিকে সম্পর্কের ‘শেষ ধাক্কা’ বলা হচ্ছে। এরপর আর ট্রাম্প–মোদির মধ্যে কোনো ফোনালাপ হয়নি।
ট্রাম্প এতে রুষ্ট হয়ে ভারতের ওপর শাস্তি দেন। রুশ তেল কেনা অব্যাহত রাখায় শুল্কহার বাড়িয়ে ৫০ শতাংশে নিয়ে যান এবং চলমান বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করেন। যুক্তরাষ্ট্রের এই কঠোর অবস্থানে ভারতীয় জনমত ক্ষুব্ধ হয়ে সরকারের কাছে শক্ত প্রতিক্রিয়ার দাবি জানাচ্ছে। বিরোধীরা আগেই মোদিকে ‘নারেন্ডার সারেন্ডার’ বলে কটাক্ষ করছিল, এবার আরও সরব হয়েছে। কিন্তু মোদি সরকারের হাতে কার্যকর কোনো বিকল্প নেই। কারণ, অর্থনীতি, প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা ও কূটনৈতিক সমর্থনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য শক্তিশালী ভরসা নেই।
চাপ সামলাতে নয়াদিল্লি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। ২০২০ সালের সীমান্ত সংঘর্ষের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। তবে সাত বছর পর চীন সফরে গিয়ে মোদি সি চিন পিংয়ের সঙ্গে হাত মেলান। সি প্রতীকী বার্তা দেন, “হাতি আর ড্রাগন একসঙ্গে নাচুক।” তবু দুই দেশের মধ্যে আস্থার ঘাটতি রয়েই গেছে। একই সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে মোদির দীর্ঘ আলাপ হয় এবং তাঁকে ভারত সফরে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কিন্তু রাশিয়া বর্তমানে ইউরোপে একঘরে, তাদের সহায়তার ক্ষমতাও সীমিত।
এ ছাড়া জাপানসহ কিছু দেশ ভারতের পাশে দাঁড়াতে চাইলেও তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প নয়। জাপান অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে পারে, তবে কৌশলগত শক্তি যথেষ্ট নয়। তাই সবদিক মিলিয়ে নয়াদিল্লির বিকল্প পথ কার্যত বন্ধ হয়ে আসছে।
মোদির রাজনৈতিক অবস্থানও নড়বড়ে হয়ে উঠছে। একদিকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে মার্কিন চাপ, অন্যদিকে দেশে বিরোধীদের তীব্র সমালোচনা—দুই সংকট একসঙ্গে মোকাবিলা করতে হচ্ছে তাঁকে। আগামী দিনে মোদি যদি ট্রাম্পের মন জয় করতে না পারেন বা নতুন কোনো সমঝোতার পথ না খুঁজে পান, তবে ভারতের জন্য আসছে কয়েক বছর খুবই কঠিন হতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ