ঢাকার আকাশে আজও দিনের শেষে একটু গরম ভাব লেগে থাকে, কিন্তু রাজনৈতিক আবহাওয়ার তাপমাত্রা তারও অনেক ওপরে। আগামীকাল ১৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগের ডাক দেওয়া অবরোধ ও রাজধানী লকডাউনকে ঘিরে আবারও পুরোনো আতঙ্ক ফিরে এসেছে শহর ও মফস্বলে। ট্রাফিক পুলিশ থেকে শুরু করে রিকশাচালক, গার্মেন্টস কর্মী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র—সবাই একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে করছেন: কাল কী হবে?
এই প্রশ্নের পেছনে শুধু একটি কর্মসূচি নয়, আছে গত দেড়–দুই বছরের টালমাটাল রাজনীতির জমাট অভিজ্ঞতা। ২০২৪ সালের জুলাইয়ের আন্দোলন, সেই ধারাবাহিকতায় আগস্টে শেখ হাসিনার পতন, তারপর নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ক্ষমতায় আসা—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি এক নতুন অজানা পর্বে ঢুকে পড়ে। এই পরিবর্তনের পর থেকেই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ক্রমশ রাস্তায় ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজছিল; সেই পথের সর্বশেষ প্রকাশই ১০–১২ নভেম্বর সারাদেশে বিক্ষোভ–মিছিল এবং ১৩ নভেম্বর ঢাকায় ‘লকডাউন’ কর্মসূচি।
অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের টানাপোড়েনের একটি বড় চূড়ান্ত বাঁক এসেছে দলটির বিরুদ্ধে মামলাগুলোকে কেন্দ্র করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলন দমনে ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হওয়ার অভিযোগ তুলে রাষ্ট্রপক্ষ মৃত্যুদণ্ডের দাবি করেছে—এমন খবরেই শঙ্কা বেড়েছে আওয়ামী লীগসহ তার সমর্থকদের মধ্যে। দলটির বহু নেতা–কর্মী বিশ্বাস করছেন, এই মামলা ও অন্যান্য অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত; তাই রায়ের সম্ভাব্য তারিখের আগেই চার দিনের ধারাবাহিক কর্মসূচি, শেষ দিন ঢাকায় সকাল–সন্ধ্যা লকডাউন ঘোষণা করেছে তারা।
এখনকার বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতাচ্যুত নয়, আইনগতভাবেও এক ধরনের ‘নিষিদ্ধ’ অবস্থায়। ২০২৫ সালের মে মাসে ‘জুলাই বিপ্লব’-পরবর্তী আন্দোলনের চাপের মুখে সরকারের আইন সংশোধন, তার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ ও সংশ্লিষ্ট সংগঠনের সব কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা এবং নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে দলটির নিবন্ধন স্থগিত করা—রাজনীতির মেরুকরণকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। একসময় রাষ্ট্র পরিচালনাকারী দল আজ কার্যত নিষিদ্ধ সংগঠন, তবু রাস্তায় কর্মসূচি ঘোষণা করছে—এই বৈপরীত্য আগামীকালের অবরোধকে আরও জটিল করে তুলেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা অবশ্য আওয়ামী লীগের এ কর্মসূচিকে কেবল ‘রাজনৈতিক প্রতিবাদ’ হিসেবে দেখছেন না। বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে একাধিক গণমাধ্যম জানিয়েছে, ১৩ নভেম্বরকে ঘিরে মহাসড়ক অচল করে দেওয়ার এক পরিকল্পনার কথা—গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন প্রবেশমুখে সড়ক অবরোধ, যানবাহনে আগুন, কৌশলগত সহিংসতা ইত্যাদির শঙ্কার কথা উঠে এসেছে এসব প্রতিবেদনে। একই সঙ্গে অবৈধ অস্ত্রের চালান, ডিজিটাল যোগাযোগের মাধ্যমে নাশকতার প্রশিক্ষণ, সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু ‘সহানুভূতিশীল’ সাবেক সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগের মতো অভিযোগও উচ্চারিত হচ্ছে।
কুমিল্লায় ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আকস্মিক মিছিল, পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান ও গ্রেপ্তার—সব মিলিয়ে সরকারের বার্তাটা স্পষ্ট: নিষিদ্ধ ঘোষিত দলের নামে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ‘অবৈধ’ কর্মসূচি সহ্য করা হবে না। সরকারপক্ষ এটিকে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার প্রশ্ন হিসেবে তুলে ধরছে, আর আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, এটি তাদের বাকস্বাধীনতা ও সংগঠনের অধিকারের ওপর সরাসরি আঘাত।
এদিকে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি বাংলাদেশের রাজনীতির অন্য ফ্রন্টকেও প্রভাবিত করছে। একদিকে রয়েছে আওয়ামীবিরোধী সেই বৃহৎ জোট, যারা গত মে মাসে ‘ন্যাশনাল অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট ইউনিটি’ ব্যানারে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে শাহবাগ অবরোধসহ দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল; তাদের দাবি–দাওয়া ও চাপের মুখেই শেষ পর্যন্ত দলটির কার্যক্রম বন্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত হয়। অন্যদিকে, এখন ইসলামপন্থী জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন ইসলামী দল ও অংশবিশেষ জাতীয়তাবাদী শক্তি ‘জুলাই ন্যাশনাল চার্টার’কে গণভোটের মাধ্যমে বৈধতা দেওয়ার দাবি তুলছে, যাতে আগামী নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ও রাজনৈতিক সংস্কারের নানা প্রস্তাব রয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের অবরোধ–লকডাউনকে অনেকে দেখছেন এক ধরনের ‘কাউন্টার ন্যারেটিভ’ হিসেবে। দলটি বলছে, জুলাইয়ের আন্দোলনকে ব্যবহার করে তাদের বিরুদ্ধে ‘রাজনৈতিক প্রতিশোধ’ নেওয়া হচ্ছে; তাদের নেত্রী শেখ হাসিনা ও অন্যদের বিচারের নামে নির্বাচনবিহীন এক ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ট্রানজিশনকে স্থায়ী করার চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে আওয়ামীবিরোধী শিবিরের দাবি, ১৫ বছরের ‘স্বৈরশাসন’ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় এড়াতে চাইছে আওয়ামী লীগ; অবরোধ–হরতালের মাধ্যমে তারা পুনরায় অস্থিরতা সৃষ্টি করে আন্তর্জাতিক মহলকে বিভ্রান্ত করতে চায়।
আগামীকাল রাস্তায় নেমে আসবে কারা—এই প্রশ্নের উত্তরও সরল নয়। একদা ক্ষমতাসীন এই দলের সাংগঠনিক কাঠামো গত এক বছরের দমন–পীড়ন, গ্রেপ্তার, মামলার চাপে ছিন্নভিন্ন; অনেক শীর্ষ নেতা এখন দেশের বাইরে, অনেকে আত্মগোপনে। ফলে মাঠের বোঝা অনেকটাই পড়ে গেছে মধ্যম সারি ও প্রান্তিক নেতাকর্মীদের ওপর, যাদের অনেকেরই ব্যক্তিগত জীবনে মামলা, পেশাগত অনিশ্চয়তা, পরিবার নিয়ে উদ্বেগ—সব মিলিয়ে রাজনীতির সঙ্গে বেঁচে থাকার হিসাব জড়িয়ে গেছে। তবু সোশ্যাল মিডিয়া পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, তরুণ–যুবক, পুরোনো ছাত্রলীগ কর্মী থেকে শুরু করে উপেক্ষিত স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে ‘আবার মাঠে নামার’ এক ধরনের আবেগ কাজ করছে, যা নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের একাংশের কাছে ঝুঁকি হিসেবেই ধরা পড়ছে।
রাজনৈতিক উত্তাপের সবচেয়ে বড় অভিঘাত পড়ে সাধারণ মানুষের জীবনে। ঢাকার গুলিস্তানের এক ছোট কাপড় ব্যবসায়ী হয়তো কাল দোকান খুলবেন, কিন্ত ভেতরে ভয়ে কাঁপবেন—‘কোনো ঝামেলা হলে পালাতে পারব তো?’ পাবনা থেকে ঢাকায় কাঁচামাল আনতে যাওয়া ট্রাকচালক হয়তো আজ রাতেই ফোনে ঠিক করছেন, কাল রওনা দেবেন কি দেবেন না। শিল্পাঞ্চলগুলোতে মালিকরা ভাবছেন, গার্মেন্টস–ফ্যাক্টরি চালু রাখলে শ্রমিকদের যাতায়াত কীভাবে নিশ্চিত করবেন, আর বন্ধ রাখলে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে কী বার্তা যাবে। প্রতিটি অবরোধ–হরতাল মানে বাংলাদেশের প্রাত্যহিক জীবনে নতুন করে অর্ডার বাতিল, ডেডলাইন মিস, দিনমজুরের পেটে লাথি।
আন্দোলন ও অবরোধের রাজনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় নতুন নয়। ৯০–এর সামরিক শাসনবিরোধী সংগ্রাম, ৯৫–৯৬–এর নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাত, ২০১৩–১৪–এর সহিংস হরতাল–অবরোধ—সব মিলিয়ে ‘রাজপথ’ যেন এখানে গণতান্ত্রিক চর্চার যেমন অংশ, তেমনি সহিংসতারও স্মৃতিভাণ্ডার। পার্থক্য হলো, এবারের টানাপোড়েনে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী—দুই পক্ষের বিন্যাস পাল্টে গেছে। যে আওয়ামী লীগ একসময় রাস্তায় আন্দোলনের প্রতীক ছিল, পরে দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতীক হয়ে ওঠে, এখন আবার ‘নিষিদ্ধ’ অবস্থায় রাজপথের রাজনীতিতে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে; আর যারা একসময় তাদের অবরোধের ভুক্তভোগী ছিল, তারাই এখন ‘আইনের শাসন’ ও ‘স্থিতিশীলতার’ ভাষ্য নিয়ে মাঠে।
এ অবস্থায় আগামীকালের অবরোধ কি কেবল একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি, নাকি ভবিষ্যতের বৃহত্তর সংঘাতের রিহার্সাল—এই বিতর্কও উসকে উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থক ও অংশবিশেষ নাগরিক সমাজ মনে করে, যেহেতু একটি নতুন নির্বাচনব্যবস্থা ও ন্যাশনাল চার্টার নিয়ে আলোচনা চলছে, তাই এখন যে কোনো সহিংস আন্দোলন এই প্রক্রিয়াকে বিপথগামী করতে পারে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সমর্থকরা যুক্তি দিচ্ছেন, যখন তাদের অস্তিত্বই প্রশ্নের মুখে, তখন ‘স্ট্যাটাস কো’ মেনে বসে থাকা মানে ইতিহাসের আদালতে আত্মসমর্পণ; তাই রাস্তায় নামা ছাড়া উপায় নেই।
এই টানাপোড়েনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে নির্বাচন প্রসঙ্গ। অন্তর্বর্তী সরকার ও তাদের সমর্থিত শক্তিগুলো ২০২৬ সালের শুরুতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের কথা বলছে, সঙ্গে চাইছে জাতীয় চার্টারকে গণভোটের মাধ্যমে বৈধতা দিতে। অপরদিকে, নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগকে রাজনীতির ময়দানে স্থান না দিয়ে কোনো নির্বাচন কতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে, সে প্রশ্ন তুলছে আন্তর্জাতিক মহলের একটি অংশও। আলাপ হচ্ছে, কোনো বড় গণভিত্তিক দলকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ রেখে দীর্ঘমেয়াদে কি সত্যিই স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব, নাকি তা আরও ভূগর্ভস্থ সহিংসতা ও চরমপন্থাকে উসকে দেবে।
রাত যত গভীর হচ্ছে, ততই ঢাকার মোড়ে মোড়ে পুলিশি তৎপরতা বাড়ছে, চেকপোস্ট বসছে, মুভমেন্ট সীমিত করার আলোচনা চলছে। বাস মালিক সমিতিগুলো অনেকে আনঅফিশিয়ালি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে কাল গাড়ি না নামানোর, যাতে ভাঙচুর–আগুন থেকে অন্তত নিজেদের বাঁচানো যায়। আবার কিছু রাইডশেয়ার চালক, কুরিয়ার সার্ভিসের তরুণ ঠিক করেছেন, ঝুঁকি নিয়েও বের হবেন—জীবিকার টানে। রাজনীতির এই বৃহৎ টানাপোড়েনের মাঝের এই ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তগুলোই আসলে বাংলাদেশের বাস্তবতা—এখানে কেউ পুরোপুরি রাজনীতি থেকে বের হয়ে যেতে পারে না, আবার পুরোপুরি রাজনীতির অংশও হয়ে উঠতে পারে না।
অবরোধের আগের সন্ধ্যায় দেশের রাজনৈতিক অবস্থা তাই ‘উত্তপ্ত’ বলেই শুধু থেমে নেই; তা এক ধরনের অনিশ্চয়তার ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে। আগামীকাল রাস্তায় কী হবে, তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ; তারচেয়েও বড় প্রশ্ন—আগামী দিনের রাষ্ট্রকাঠামো, বিচার ও জবাবদিহির ভবিষ্যৎ কী হবে। ন্যায়বিচার চাই, আবার স্থিতিশীলতাও চাই; জবাবদিহি চাই, আবার অন্তর্ভুক্তিও চাই—এই পরস্পরবিরোধী আকাঙ্ক্ষাগুলোর মাঝখানেই দাঁড়িয়ে আজকের বাংলাদেশ। অবরোধের দিন পেরিয়ে রাজনীতি যদি সংলাপ ও আপসের পথে ফিরতে না পারে, তবে আগামী অনেকগুলো ১৩ নভেম্বরই হয়তো আমাদের কাছে বারবার ফিরে আসবে ভয়ের, ক্ষোভের ও অনিশ্চয়তার নতুন নতুন রূপ নিয়ে।
আপনার মতামত জানানঃ